সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ‘অবৈধ’, ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ

রাজধানী ঢাকা সিটি কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক কাজী নেয়ামুল হকের নিয়োগ অবৈধ। অন্যদিকে আগের অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিনের পদত্যাগ সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সঠিক হয়নি। একইভাবে উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর বাধ্যতামূলক অবসর এবং ছয় জন শিক্ষকের বহিষ্কারও অবৈধ। তাই ‘অবৈধ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বৈধ অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ সব শিক্ষককে স্বপদে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্প্রতি কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে পত্র দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে সাত দিনের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করতে বলা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ মার্চ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতিকে এই নির্দেশনা দিলেও এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি গভর্নিং বডি।
জানতে চাইলে গভর্নিং বডির সভাপতি ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে গত ২৬ মার্চ গভর্নিং বডির একটি মিটিং করেছি। মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কলেজ পরিদর্শক আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকারকে পাঠিয়েছি। গভর্নিং বডি অধ্যাপক বেদার উদ্দিনকে বরখাস্তও করেনি, বহালও করেনি। আমাদের কিছু করণীয় নেই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষকদের জোর করে পদচ্যুত করার হিড়িক শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক বেদার উদ্দিন আহমেদকে গত বছরের ৭ আগস্ট জোর করে পদত্যাগ পত্রে সই করিয়ে নেন কথিত ‘ছাত্র-জনতা’। একই দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে চেয়ারে বসেন অধ্যাপক কাজি নেয়ামুল হক। চেয়ারে বসেই স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়ে অধ্যাপক কাজী নেয়ামুল হক গত ১১ আগস্ট বৈধ অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ এবং ছয় শিক্ষককে অফিস আদেশ দিয়ে কলেজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এই ছয় শিক্ষক হলেন— বাংলা বিভাগের মো. দেলোয়ার হোসেন, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ফরিদা পারভীন, ভুগোলের চৈতালী হালদার, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের আহসান হাবিব রাজা ও একই বিভাগের কায়কোবাদ সরকার এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আল ফয়সাল আকতার। শুধু তাই নয়, উপাধ্যক্ষ পদেও জোর করে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে মোখলেছুর রহমানকে পদে বসিয়ে দেন। পরে ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এসব ঘটনায় ঢাকা সিটি কলেজে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বেশ কিছুদিন কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পদচ্যুত অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন হাইকোর্টে রিট করলে হাইকোর্ট একটি রুল ও নির্দেশনা জারি করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরেজমিন তদন্ত করে কলেজটির বর্তমান সভাপতিকে সম্প্রতি চূড়ান্তভাবে একটি সুপারিশ করেন। সুপারিশে আগের অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিনকে জোর করে পদত্যাগ করানো, উপাধ্যক্ষকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং ছয় জন শিক্ষকের বহিষ্কার অবৈধ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন বলেন, ‘আমাকে ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট দুজন শিক্ষকের নেতৃত্বে কতিপয় প্রাক্তন ছাত্র ও বহিরাগতরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জোর করে একটি লিখে আনা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। আমি তৎক্ষণাৎ জিডি করে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করি এবং স্বপদে পুনর্বহালের আবেদন জানাই। তৎকালীন গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান আমার আবেদনপত্রে লিখে দেন যে, জোরপূর্বক পদত্যাগপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না। তা সত্ত্বেও বিভাগীয় কমিশনার চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করার আগেই কোনোরূপ মিটিং ছাড়াই একটি অফিস আদেশের মাধ্যমে একাই আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং একই আদেশের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছেন, যা বিধি মোতাবেক হয়নি।
তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই-তিন জন শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্র সমন্বয়কের পরিচয় দিয়ে জোর করে আমার কাছ থেকে অফিস আদেশটি নিয়েছে।’
অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমাকে পুনর্বহালের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকের প্রথম স্বাক্ষরিত পত্রে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা কোনও তদন্তের আলোকে হয়নি। সেখানে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক লুৎফর রহমানের কক্ষে একটি শুনানির আয়োজন করে শুধু আমার এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়ামুল সাহেবের বক্তব্য শোনা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত ওই চিঠিতে আমার বক্তব্য ও প্রমাণপত্র উপেক্ষা করে একপেশে ও মনগড়া সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২০ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে পদচ্যুত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ততদিন বহাল রাখতে বলেছে যতদিন না মন্ত্রণালয় তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ সেটাও মানছে না। আমরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক মো. আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকারের গত ১৬ মার্চের সুপারিশপত্রে বলা হয়, অধ্যক্ষ অধ্যাপক বেদার উদ্দিন আহমেদকে জোর করে পদত্যাগ করানো সরকারি প্রজ্ঞাপন মোতাবেক সঠিক হয়নি। এমতাবস্থায়, অধ্যাপক বেদার উদ্দিন আহমেদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহিত করতে হবে।
জোর করে পদে বসা অধ্যাপক কাজি নেয়ামুল হকের নিয়োগ বৈধ না হওয়ায় বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় সুপারিশপত্রে।
সুপারিশপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, উপাধ্যক্ষকে সরানো ও ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ নিয়োগ বিষয়ে অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন চৌধুরীকে তার পদে পুনর্বহাল করার সুপারিশ বাস্তবায়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করতে হবে।
কলেজের ছয় জন শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার আদেশ সঠিক না হওয়ায় তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয় সুপারিশপত্রে।
এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করার জন্য সভাপতিকে অনুরোধ করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত ও সুপারিশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গভর্নিং বড়ির সভাপতি ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘উনারা (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) যে তদন্ত করেছেন, তাদের (তদন্ত কমিটি) যে কাজের পরিধি দেওয়া হয়েছিল সেখানে বলা আছে বেদার উদ্দিন সাহেবের সম্পর্কে। কিন্তু তিনি তদন্ত করেছেন (কলেজ পরিদর্শক) বেদার উদ্দিন ছাড়াও এর বাইরের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়ে। কলেজ পরিদর্শক আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকার এর আগে নিজেই চিঠি দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে বেদার উদ্দিন সাহেবের কলেজে ফিরে আসার সুযোগ নেই।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেদার উদ্দিন সাহেবকে গভর্নিং বডি তাকে বরখাস্ত করেনি। তিনিই পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করার পর বিভাগীয় কমিশনার পদত্যাগ গ্রহণ করেছেন। তার গ্রহণ করা পদত্যাগপত্রটিই আমরা গভর্নিং বডিতে অ্যাপ্রুভাল দিয়েছি। তার পরে তিনি আবার আবেদন করেছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছেন। আবার তার চাকরি এখানে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। একই ব্যক্তি কী করে চিঠি দেয় তার চাকরি শেষ আবার বলে পদে বহাল রাখার জন্য। এটা অত্যন্ত হাস্যকর। বেদার উদ্দিনকে আমরা বরখাস্ত করিনি, বহালও করিনি। আমাদের কিছু করণীয় নেই।’