ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সাথেও বেঈমানি করেছিলেন ড. কামাল হোসেন!


১৮ নভেম্বর ২০১৮ ২৩:০২

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৫৫

 

।। আবদু গাফ্‌ফার চৌধুরী ।।

 

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ যদি বিষ্ণু দের কবিতার অর্থ বোঝাতে পারে, তাকে আমি শিরোপা দেব।’ আমার মতো এক নগণ্য সাংবাদিকের কথা হলো, কেউ যদি আমাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর রাজনীতির আসল অর্থ বোঝাতে পারেন, তাঁকে আমি শিরোপা দেব।

 

কাদের সিদ্দিকীকে আমি গণনায় ধরি না। মাথার বদলে হাঁটুতে মগজ নিয়ে রাজনীতি করলে যা হয় কাদের সিদ্দিকী তা-ই। মুক্তিযুদ্ধকালে সত্যি ছিলেন বাঘ। এখন কাগজের বাঘ, পেপার টাইগার।

 

আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ এখন রাজনৈতিক এতিম। মুরব্বি না পেলে তাঁরা রাজনীতি করতে পারেন না। সব মুরব্বি হারিয়ে এখন তাঁরা ড. কামাল হোসেনকে রাজনৈতিক মুরব্বি হিসেবে ধরতে চাইছেন। কিন্তু ড. কামাল তাঁদের মুরব্বি হতে সম্ভবত নারাজ। অন্তত ঢাকার কাগজের খবরে তা-ই দেখলা।

 

ড. কামাল ও ডা. বদরুদ্দোজা মিলে যে যুক্তফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা দেওয়ার কথা, তা আটকে গেছে। ঘোষণায় আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নারও নাম ছিল। ড. কামাল তা কেটে দিয়ে আমেরিকায় চলে যাওয়ায় রব ও মান্নার প্রতিবাদের মুখে ঘোষণাটি আটকে গেছে। ঈদের পর ড. কামাল দেশে ফিরবেন, তখন এই ঘোষণার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।

 
 

জন্মের আগেই যুক্তফ্রন্ট নামক এই শিশুর যে অবস্থা, তাতে জন্মের পর তার অবস্থা কী হবে? এই রুগ্ণ শিশুকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বহু বিতর্কিত ডা. জাফরুল্লাহ। তিনি বরের ঘরের পিসি এবং কনের ঘরের মাসি। আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দলের—বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের সুহৃদ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কতটা মোকাবেলা করতে পারবে সে সম্পর্কে আশাবাদী না হওয়ায় এই রাজনৈতিক নারদ ঠাকুর এখন আওয়ামীবিরোধী এবং তথাকথিত সুধীসমাজ সমর্থিত একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনে উত্সাহী। তলে তলে এই সম্ভাব্য যুক্তফ্রন্ট ও বিএনপির ২০ দলীয় জোটের মধ্যে একটি সমঝোতা সৃষ্টিরও চেষ্টা চলছে।

 

এই সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পথে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু একমাত্র হাসিনাবিদ্বেষ ছাড়া এদের মধ্যে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই, ঐক্যও নেই। ডা. বদরুদ্দোজা তো নিজেই বিএনপির লোক ছিলেন। জিয়াউর রহমানের মুসলিম (বাংলাদেশি) জাতীয়তাবাদে ঘোর বিশ্বাসী। ‘জিয়াবাদ’ নামক কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো বইও লিখেছেন। ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর এক হাতে গীতা, আরেক হাতে কোরআন। আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়া হলে গীতাকে ভোট দেওয়া হবে এবং বিএনপিকে ভোট দেওয়া হলে কোরআনকে ভোট দেওয়া হবে।

 

ড. কামাল হোসেন কেন আওয়ামী লীগে ঢুকেছিলেন আমি জানি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন সারা বিশ্বে পরিচিত উদীয়মান নেতা। সম্ভবত অর্ধপরিচিত তরুণ আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন পেশায় এবং রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য। তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে তিনি কতটা বিশ্বাস করতেন, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেও আমি তা বুঝতে পারিনি।

 

তাঁর প্রতি আমার কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। বরং বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা যখন রাজনৈতিক মঞ্চে আসেননি তখন অক্সফোর্ডে সপরিবারে বসবাসরত ড. কামাল হোসেনের দিকেই অনৈক্য জর্জরিত ও নেতৃত্বহীন আওয়ামী লীগে ঐক্য ফিরিয়ে আনা এবং নেতৃত্বদানের আশায় তাকিয়েছিলাম। এই আশায় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতারা প্রয়াত গউস খানের নেতৃত্বে বারবার অক্সফোর্ডে দৌড়ে গেছেন। তিনি তাতে সাড়া তো দেনইনি, বরং উল্টো কাজ করেছেন।

 
 

তিনি যে সেক্যুলারিজম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি বহুদিন আগে এক ঘটনায়। তখন আমি প্রায়ই লন্ডন থেকে অক্সফোর্ডে যেতাম ড. কামাল হোসেনের বাসায়। সেখানে ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান ও মোশাররফ হোসেন অর্থাৎ ড. কামাল হোসেনের এই বন্ধুরাও উপস্থিত থাকতেন। আমি তাঁদের নাম দিয়েছিলাম গ্যাং অব ফোর। একদিন ড. কামালের বাসায় এ ধরনের এক বৈঠকে প্রশ্ন উঠল, বাংলাদেশ কি সেক্যুলারিজম গ্রহণ করবে, না মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এই বৈঠকে সেদিন শুধু মোশাররফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

 

বাংলাদেশে তখন জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়েছেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নাম দিয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন। তাঁকে সহযোগিতা দিচ্ছেন আবুল মনসুর আহমদের ভায়রা খোন্দকার আবদুল হামিদ। আবুল মনসুর আহমদ এখন বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর শিষ্য ও আত্মীয়টি তাঁর থিয়োরিটি প্রচার করছিলেন। অক্সফোর্ডের সেদিনের আসরে মোশাররফ হোসেন দৃঢ়ভাবে সেক্যুলার বাংলার পক্ষে কথা বলেছিলেন। আর ড. কামাল হোসেন খুবই মৃদু কণ্ঠে মুসলিম বাংলার পক্ষে কথা বলছিলেন। তাঁর চরিত্রের একটা দিক তখনই আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয়েছিল।

 

এরপর দুটি ঘটনায় তাঁর প্রতি আমার আস্থা ও শ্রদ্ধা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। তিনি আমার চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট। তবু তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের কথা। লন্ডনের ইন্ডিয়া উইকলি কাগজের সম্পাদক ছিলেন ড. তারাপদ বসু। তিনি একদিন আমাকে চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুল ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি গউস খানকে জানান, আমরা যেন এখনই ব্রিটিশ লেবার দলের এমপি সিডনি বিডওয়েল, মাইকেল বার্নস ও পিটার শোরের সঙ্গে দেখা করি। মাইকেল বার্নস ও পিটার শোর দুজনই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বন্ধু। সিডনি বিডওয়েলও ছিলেন বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী।

 

মাইকেল বার্নস আমাদের জানালেন, ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ একটি সূত্রে জানতে পেরেছে জেলে বন্দি তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় নেতাদের হত্যার একটা চেষ্টা চলছে। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। তবে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় নেতা ব্রিটিশ সরকারকে এ ব্যাপারে অনুরোধ জানালে বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপন করে জেলে নেতাদের অবস্থা জানার জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের ওপর তারা চাপ দিতে পারে এবং জেলে বন্দি নেতাদের জন্য লিগ্যাল এইডের ব্যবস্থা করতে পারে। এ কথা শোনার পর আমরা ছুটে যাই অক্সফোর্ডে ড. কামাল হোসেনের কাছে। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এবং ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের খুবই পরিচিত। তাঁর কথায় ব্রিটিশ সরকার গুরুত্ব দেবে। কিন্তু কামাল হোসেনের কাছে গিয়ে তাঁকে সব কথা জানাতেই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘না, না, এসব গুজবে কান দেবেন না। আমরা এসব কথা বলাবলি করলে ওরা সত্যি সত্যি নেতাদের মেরে ফেলবে। না হলে নেতারা নিরাপদ থাকবেন।’

 
 

তিনি কিছুতেই আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। আমরা হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। এর কিছুদিন পরই নভেম্বর মাসের গোড়ায় ঢাকা জেলে চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সুদূর লন্ডনে বসে আমাদের তখন আর কিছু করার নেই একটি শোকসভা করা ছাড়া। ১৯৭৫ সালের ১৩ নভেম্বর তাসাদ্দুক আহমদ, মইদুল হাসান (মূলধারা ’৭১ বইয়ের লেখক) এবং আমি আহ্বায়ক হয়ে লন্ডনের কনওয়ে হলে একটি শোকসভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। এ সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী ক্ষমতা দখলকারী মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে আমাদের সভায় যোগ দিতে রাজি হন।

 

কিন্তু কামাল হোসেন এ সভায় যোগ দিতে আর রাজি হন না। অবশেষে তাঁর বন্ধু মইদুল হাসান তাঁকে রাজি করার ভার নেন এবং বুঝিয়েসুজিয়ে সভায় নিয়ে আসেন। এ সভায় মোশতাকের সমর্থকরা হামলা চালায়। সভার দর্শকরা তা প্রতিহত করে। এমনকি জাস্টিস চৌধুরীও সব বাধা অগ্রাহ্য করে বক্তৃতা দেন। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল ড. কামাল হোসেন সভায় নেই। তিনি কাউকে কিছু না বলে, বক্তৃতা না দিয়ে কনওয়ে হলের পেছনের দরজা দিয়ে চলে গেছেন।

 

এবার দ্বিতীয় ঘটনা। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু হত্যার বছর কয়েক পরের ঘটনা। জিয়াউর রহমান তাঁর হাতের পুতুল বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি পদ দখল করেন। নিজের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বিশ্ববাসীর কাছে বৈধ করার লক্ষ্যে তাঁর পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য দেশের কিছু প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত বামপন্থী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে বিদেশে পাঠাতে শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান মিন্টু। এনায়েতুল্লাহ খান ইউরোপে এসে প্রথমে সুইডেনের টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যা বললেন, তা শুধু সমালোচনা ছিল না, ছিল নির্লজ্জ গালাগাল।

 

লন্ডনে বসে আমরা বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা ঠিক করলাম এই প্রচারণার প্রতিবাদ জানাব। আমরা সুইডিশ টেলিভিশনকে জানালাম, আমাদের পাল্টা বক্তব্য প্রচার করতে হবে। সুইডিশ টেলিভিশন রাজি হলো এবং লন্ডনে আমাদের বক্তব্য রেকর্ড করতে আসতে চাইল। আমরা ড. কামাল হোসেনকে অনুরোধ জানালাম, তিনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও অনুসারী বলে দাবি করেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের বিরুদ্ধে তিনি যেন সুইডিশ টেলিভিশনে কথা বলেন। তিনি রাজি হলেন।

 

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ তখন ঢাকা থেকে লন্ডনে চলে এসেছেন। আমরা দুজনে মিলে সেন্ট্রাল লন্ডনে অভিজাত চার্চিল হোটেলে একটি কক্ষ ভাড়া নিলাম। ওই কক্ষেই সুইডিশ টেলিভিশন আমাদের বক্তব্য রেকর্ড করবে। আমাদের তখন টাকা-পয়সা নেই। নিজেদের পকেট এবং বন্ধুবান্ধবের টাকা নিয়ে হোটেলের ভাড়া মেটালাম। সকাল ১০টায় রেকর্ডিং শুরু হবে। ড. কামাল এর আগেই এসে পৌঁছবেন কথা দিয়েছেন। সুইডিশ টেলিভিশন যন্ত্রপাতি নিয়ে ১০টার আগেই এসে গেছে। ১০টা, সাড়ে ১০টা, ১১টা, দুপুর ১২টায়ও কামাল হোসেন আর এসে পৌঁছেন না। অতঃপর আমি আর সুলতান শরীফ যা পারি তা বলেছি। সুইডিশ টেলিভিশন তা প্রচার করেছে।

 
 

এ রকম ঘটনা একবার নয়, কয়েকবার ঘটেছে। আজ সব ঘটনা লিখে পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে লিখব। প্রসঙ্গত, একটি ঘটনার কথা বলে বিষয়টি শেষ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ড. কামালকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আইয়ুব-ইয়াহিয়ার অনুগ্রহভোগী এক বাঙালি বুদ্ধিজীবী ড. জি ডাব্লিউ চৌধুরী (গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরী) ‘লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’ নামে একটি বই লেখেন। এতে একাত্তরের গণহত্যার বর্বরতাকে এড়িয়ে গিয়ে পাকিস্তান ভাঙার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দায়ী করেন।

 

বঙ্গবন্ধু এই বইয়ের মিথ্যা প্রচারণার জবাবদানের জন্য ড. কামাল হোসেনকে অনুরোধ জানান। ড. কামাল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও চাতুরী করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানান, বইটি লেখার জন্য তিনি তিন মাস সময় চান এবং তিন মাস অক্সফোর্ডে বাস করবেন। তিনি নবগঠিত বাকশাল মন্ত্রিসভায় শপথ না নিয়ে অক্সফোর্ডে চলে আসেন। আমিও তখন লন্ডনে। বঙ্গবন্ধু মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললে বলতেন, ‘কামাল বইটির কতদূর করেছে জানো?’ আমি বলতে পারতাম না।

 

অক্সফোর্ডে তখন মাঝেমধ্যেই যেতাম। ড. কামালকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘প্রায় গুছিয়ে এনেছি। শিগগিরই লেখা শুরু করব।’ সেই বই তিন মাসেও লেখা হয়নি, এমনকি বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও নয়। এর পরও শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাঁকে শুধু রাজনৈতিক অভিভাবক হিসেবে নয়, পারিবারিক অভিভাবক হিসেবেও গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি বিএনপির জাস্টিস সাত্তারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নও দিয়েছিলেন। তিনি জেতেননি। দেশের মানুষ তাঁকে বহু আগেই চিনে ফেলেছে। তাই রাষ্ট্রপতি পদে কেন, জাতীয় সংসদের সদস্য পদেও ভোট দেয়নি।

 

বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের পরম আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিদানও তিনি দিয়েছেন চমৎকারভাবে। দীর্ঘ ২১ বছর পর দেশ যখন স্বৈরাচারী শাসনমুক্ত এবং শেখ হাসিনা প্রচণ্ড বাধা-বিপত্তি ও চক্রান্তের মুখে, যখন গণতান্ত্রিক শাসনকে স্থিতিশীল রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত তখন দলের ভেতর প্রথম যে বিভীষণ বেরিয়ে এলেন তিনি ড. কামাল হোসেন। তিনি নানা ষড়যন্ত্র পাকিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর শেখ হাসিনার পিঠে ছুরি মারতে চেয়েছেন বারবার। কখনো কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ঘোঁট পাকিয়ে, কখনো ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে জোট বেঁধে, কখনো বিএনপি-জামায়াতকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে (২০০১), কখনো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ড. ইউনূসকে উসকে দিয়ে, কখনো পশ্চিমা কূটনীতিকদের কাছে কান কথা বলে এবং এখন ২০০১ সালের নির্বাচনের সময়ের প্রচ্ছন্ন ভূমিকাকে প্রকাশ করে দিয়ে কিছু রাজনৈতিক এতিম দল ও নেতা নিয়ে হাসিনাবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়তে চান।

 
 

এখন শোনা যাচ্ছে, এই যুক্তফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপির ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সখ্য গড়ারও একটা উদ্যোগ চলছে। বিস্ময়ের কথা, বিএনপিতে তারেক রহমানের নেতৃত্ব মেনে যেখানে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ তাঁদের গোত্রের অন্যান্য নেতাও বিএনপি জোটের সঙ্গে যুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করেছেন, সেখানে ড. কামাল হোসেন নাকি বিএনপির সঙ্গে মিতালি পাতাতে তারেক রহমানের ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। খবরটি পড়ে মনে মনে বলেছি, ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই।’

 

বেশিদিনের কথা নয়, বছর পাঁচেক আগে বন্ধুবর মোনায়েম সরকারের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের বাসায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি কথায় কথায় বলেছেন, ‘তারেক রহমানের মতো এক দুর্বৃত্ত যদি এ দেশের রাজনৈতিক নেতা হয়, তাহলে স্থায়ীভাবে এ দেশ ছেড়ে চলে যাব। ঢাকার দেয়ালে তারেকের নামে নানা স্তুতিমূলক পোস্টার দেখে ঘৃণায় সর্বাঙ্গ জ্বলে।’ সেলুকাস, বিচিত্র রঙে ভরা এ বঙ্গদেশ! সেদিনের কামাল হোসেন আজ হাসিনাবিদ্বেষে অন্ধ হয়ে তারেক রহমানের মতো তাঁরই কথিত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের সঙ্গে নাকি মিতালি পাতাতে চান।

 

বহু বছর আগে ড. কামাল অক্সফোর্ডে থাকাকালেই আমি তাঁর নাম দিয়েছিলাম মাকাল হোসেন। এতে শেখ রেহানা আমার ওপর রুষ্ট হয়েছিলেন। তখন দুই বোনের কাছে ড. কামাল হোসেন ছিলেন বিগ আংকেল, এখন সেই বিগ আংকেলের ভূমিকা দেখে তাঁরা কী ভাবছেন তা বোঝা কষ্টকর নয়। সব শেষে একটি কথা, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার ব্যক্তি সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁদের দুজন হলেন ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বাকি দুজনের নাম বলা প্রধানমন্ত্রীর উচিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের কোনো নেতা তাঁদের নাম বললে ভালো হতো। কারণ প্রধানমন্ত্রীর মুখে তাঁদের নাম উচ্চারিত হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁরা অর্জন করেননি।

 

লন্ডন, রবিবার, ২৭ মে ২০১৮ পরিচিতি: গ্রন্থকার, কলাম লেখক ও রাজনীতি বিশ্লেষক