নেছারাবাদের ছাত্রজাগরণ: ঐতিহাসিক ১৯ জুলাই ২০২৪

২০২৪ সালের জুলাই মাস। যখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দুঃশাসন ও স্বৈরাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন সারাদেশের ছাত্রসমাজ একধরনের ভয়ের আবহে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই স্তব্ধতা ভাঙে ১৯ জুলাই, যখন নেছারাবাদ উপজেলায় এক নতুন ছাত্রজাগরণ ইতিহাসের পাতায় লেখা হতে থাকে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট লেখক, ডা. আজিম শেখ রনি বলেন, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব ওয়াহিদুজ্জামান ওয়াহিদ ভাইয়ের সরাসরি নির্দেশনায়, মেসেঞ্জারে একটি গ্রুপ খুলি এবং নেছারাবাদের ছিন্নভিন্ন শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করার কৌশল গ্রহণ করি। নির্দেশনা ছিল স্পষ্ট—"কোন ব্যানারে নয়, একটি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হও"। তখন মুশফিকা জাহান তানহা (নারী শ্লোগান দাতা) এর সাথে কথা বলে মেসেঞ্জার গ্রুপ কে একটিভ করি। আমি পরিকল্পনামাফিক আড়ালে থাকি, যাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই নেতৃত্বে থাকে। সে অনুযায়ী মুশফিকা জাহান তানহা (নারী স্লোগান দাতা), মারজান, রিদিকা, আতিকা, মাহিয়া ও অন্যান্যরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ঐক্যের বার্তা পৌঁছে দেয়"। প্রাথমিক ভাবে সাথে ছিলেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নির্বাহী সদস্য মোঃ শামিম ভাই।
আন্দোলনের সূচনা
১৯ জুলাই সকালে, সরকারি স্বরূপকাঠী কলেজ, কলেজিয়েট একাডেমি ও সুটিয়াকাঠী বয়েজ স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে। মিছিল শুরু হয় —স্বরূপকাঠী সরকারি কলেজের সামনে থেকে ১০:২০ মিনিটের সময়, মিছিল পেরিয়ে যায় ইন্দুরহাট মিয়ারহাট বড় ব্রিজ হয়ে পুরাতন রোড থেকে মাছ বাজার হয়ে নতুন রোডের দিকে এবং মিছিল এসে অত্র এলাকার প্রধান পয়েন্ট বড় ব্রিজের ডালে অবস্থান নেয়। নেতৃত্বে ছিল সাধারণ ছাত্রসমাজ, যারা বুঝে গিয়েছিল—এ দেশ তাদের, এ অধিকার তাদের।
আন্দোলনকারীরা বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দেন-
“আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না”
“তুমি কে, আমি কে,
রাজাকার, রাজাকার”
“কে বলেছে, কে বলেছে
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার”
তাদের কণ্ঠে ছিল প্রতিবাদের অগ্নিশিখা, চোখে ছিল রক্তজবার মত সাহস। প্রত্যেকটি ছাত্র যেন হয়ে উঠেছিল গণতন্ত্রের একেকটি সৈনিক।
তিনি আরো বলেন,
মিছিল শুরু হওয়ার পর থেকে ৬-৮ মিনিট অন্তর অন্তর আমি আন্দোলনের অগ্রগতি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান ওয়াহিদ, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মোঃ তপু রায়হান এবং উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ইমরান হোসেন সজীব ভাইকে অবহিত করি।
আমি তাদের সঙ্গে রিয়েল-টাইমে ডাটা ট্রান্সফার করি এবং তাদের প্রত্যক্ষ পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের স্থান ও গন্তব্য পরিবর্তনসহ আন্দোলনের রুটিন সমন্বয় করি। এই ধারাবাহিক সংযোগ ও নেতৃত্বের কারণেই ১৯ জুলাইয়ের আন্দোলন কেবল একটি ক্ষণিক প্রতিবাদ নয়, বরং একটি স্থায়ী ছাত্রজাগরণে রূপ নেয়।
মিয়ারহাট ও ইন্দেরহাট বন্দরের দোকানদাররাও আন্দোলনে যোগ দেন। উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-আহবায়ক সোহেল রানা মৃধা, সেলিম রেজা, আমির হোসেন সরাসরি আন্দোলনকে সমর্থন দেন। ছাত্রদের জন্য তারা পানীয়, কেক, সিঙ্গারা সহ খাবারের ব্যবস্থা করেন।
শিক্ষার্থী, জনতা সহ
ওই আন্দোলনের মিছিলে নেতৃত্ব দেয় উপজেলা ছাত্রদল। মূলত সেদিন
সবাই ছাত্র সমাজের হয়ে রাজপথে নামে। তখন উপস্থিত ছিলেন, পিরোজপুর জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ- স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, ডা. আজিম শেখ রনি সহ সরকারি
কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি, তুষার আমিন অপু, সাবেক সদস্য সচিব, মোঃ তুহিন আমিন বাপ্পি, সিঃ সহ সভাপতি, রাসেল বাহাদুর, সহ সভাপতি, সাজিদুল ইসলাম শান্ত, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, রাকিবুল ইসলাম তালেব, মোঃ সাব্বির, মোঃ সোয়েভ তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক, জিহাদ আকন, পশ্চিম সোহাগদল শহীদ স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আরিফ। উপজেলা ছাত্রনেতা রাতুল, সৌরভ, আসিফ, রাকিবুল ইসলাম রুপক, আলিম তালুকদার, আশরাফুল, মোঃ অহি সহ অন্যান্য নেতাকর্মী।
এছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে- মারজান, মুশফিকা জাহান তানহা (নারী শ্লোগান দাতা), মোসাঃ রিদিকা আক্তার, মোসাঃ আতিকা আক্তার, মাহিয়া, আফসানা মিম, তানজিলা রথি, জিনাত আরা জুমা, থিনথিয়া নিতি, মুশফিক মাহি, খন্দকার নাজমুস সাকিব, প্রিয়ন্তি ইসলাম, আঁখি, রিফাত আহম্মেদ, ফেরদৌস আহমেদ, সাদিম, রাইয়ান, সাফিন, মোঃ সায়ান আরিজ, মিথিলা ইসলাম, ওয়ারানা হক মিলা, জান্নাতুল ফেরদৌস, উর্মি আক্তার, জারিন রাফা, জান্নাতুল শিমু।
আন্দোলনে ডা. আযিম শেখ রনি তার মূল্যবান বক্তব্যে বলেন, ঢাকা সহ সারাদেশে পুলিশের গুলিতে আমার ভাইয়েরা নিহত হচ্ছে রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে তাই আমরা সরাসরি স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগ দাবি করি এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই আপনারা আপনাদের নৈরাজ্যের লাগাম টানুন নইলে এর পরিনতি খুব ভয়াবহ হবে। আপনারা পালানোর পথ খুজে পাবেন না।
পরবর্তীতে সমাবেশের শেষপ্রান্তে সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রদলের নেতা কর্মী এবং অত্র সমাবেশের জ্যেষ্ঠ ছাত্রনেতা তুহিন আমিন বাপ্পি এর সাথে আলাপ করে ওই দিনের আন্দোলন সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তী দিন সকাল দশটায় ঠিক একই স্থানে আবারো উপস্থিত হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ১৯ জুলাইয়ের সেই ঐতিহাসিক ছাত্রজাগরণ আন্দোলন কঠোর পুলিশি বাঁধায় সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং সেইদিনেই দেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উত্তাল প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ায় রাতে সারা দেশে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা ও প্রশাসনিক কারফিউ। নিঃসন্দেহে এটি ছিল স্বৈরতন্ত্রের চরম প্রমাণ, যেখানে ছাত্রদের কণ্ঠ রোধ করতেই এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।"
১৯ জুলাইয়ের নেছারাবাদ ছাত্রজাগরণ ছিল একটি বিশ্বাসের, একটি দৃঢ় মানসিকতার নাম। এটি ছিল এমন এক আন্দোলন, যা ভয়কে জয় করে, নেতৃত্বকে আড়ালে রেখে সাধারণ ছাত্রদের সম্মুখভাগে রেখে এক নতুন ইতিহাস লিখেছিল। এই ইতিহাস শুধু ছাত্রদলের নয়, পুরো ছাত্রসমাজের—যারা মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করে না।
লেখক: ডা. আজিম শেখ রনি
সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, পিরোজপুর জেলা ছাত্রদল