ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ১০ই এপ্রিল ২০২৫, ২৮শে চৈত্র ১৪৩১

নিজের তৈরি করা বানানরীতি মানে না খোদ বাংলা একাডেমি


৭ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৫১

আপডেট:
১০ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৩১

বাংলা ভাষার প্রমিতরীতি নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি নিজেই নিজের তৈরি করা বানানরীতি মানছে না। একাডেমি প্রকাশিত সাম্প্রতিক কিছু প্রকাশনা এবং দাপ্তরিক নথিতে অসঙ্গতিপূর্ণ ও স্ববিরোধী বানান দেখা গেছে। এগুলো একাডেমিরই প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মের লঙ্ঘন বলে দাবি করছেন সমালোচকরা। এ ধরনের সমস্যা আছে স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ বলছে, বানানের বিশৃঙ্খলা চূড়ান্তভাবে মীমাংসা করা সহজ নয়।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রকাশনা ও কয়েকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিরই নির্দেশিত বানানরীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বহু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘রচনাবলি’ শব্দটি স্বীকৃত, যার সন্ধি-বিচ্ছেদ অনুযায়ী শুদ্ধরূপ ‘রচনা+আবলি’ (পৃষ্ঠা: ১১৬১)। অথচ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ে লেখা হয়েছে ‘নজরুল রচনাবলী’ ও ‘শহীদুল্লাহ্ রচনাবলী’। এখানে ‘রচনাবলী’ বানানটি অভিধানের নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

বাংলা একাডেমি বলছে, ‘উদ‌্‌বোধন’ শব্দটি প্রমিত ও মান্যরূপ (পৃষ্ঠা: ২০২)। কিন্তু বাংলা একাডেমি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছে ‘উদ্বোধন’। বাংলা একাডেমি ‘গণ অভ্যুত্থান’ (পৃষ্ঠা: ৩৮১) শব্দকে প্রমিত বললেও নিজেদের বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছে ‘গণঅভ্যুত্থান’। ‘ওয়েবসাইট’ (পৃষ্ঠা: ২৪৭) ও ‘ই-মেইল’ (পৃষ্ঠা: ১৮৪) শব্দদ্বয়কে প্রমিতরূপ দিয়ে অভিধানে ঠাঁই দিলেও বাংলা একাডেমি কয়েকটি বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছে ‘ওয়েব সাইট’ ও ‘ইমেইল’; যা স্ববিরোধী।

কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে একই শব্দকে ভিন্ন ভিন্নভাবে লেখা হয়েছে। যেমন: এক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ’। আবার আরেক জায়গায় ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’। একই বিজ্ঞপ্তিতে এক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘‘জুলাই’র গল্প’’। আবার আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘জুলাইর গল্প’। এক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘সন্ধ্যা ৭টা’, আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘সন্ধ্যা ৭ টা’।

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্ট ‘গ’-এ বাংলা তারিখ ও সময় লেখার নিয়ম বিধৃত। সে অনুযায়ী, ঘণ্টা নির্দেশক অঙ্কের পর কোলন (:) দিতে হবে; ডট (.), হাইফেন (-) বা ড্যাশ (—) ব্যবহার করা যাবে না। যখন মিনিট ছাড়া শুধু ঘণ্টা লেখা হবে, তখন ‘টা’ ব্যবহৃত হবে এবং সেটা সেঁটে না-বসে স্বতন্ত্রভাবে বসবে। আর ঘণ্টার সঙ্গে মিনিট থাকলে ‘মি:’ লিখতে হবে।

কিন্তু বাংলা একাডেমি তাদের বিজ্ঞপ্তির সব জায়গায় এ নিয়ম অগ্রাহ্য করেছে। লিখেছে ‘৫:০০টায়’, আবার কোথাও ‘৬.০০টায়’। কোথাও আবার ‘বিকেল ৫-৩০টা’। এখানে লক্ষণীয় যে, তিন জায়গায় তিনভাবে লেখা হয়েছে। কোথাও কোলন, কোথাও ডট আবার কোথাও হাইফেন। এছাড়া ‘৫-৩০টা’ না লিখে, ‘৫:৩০ মিনিট’ অথবা ‘মি:’ লিখতে হতো।

তারিখ লেখার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্ট ‘গ’ অনুযায়ী, ১লা, ২রা, ৩রা, ৪ঠা, ৫ই, ৬ই, ১৯শে, ২১শে প্রভৃতি শুদ্ধ ও মান্যরূপ। কিন্তু বাংলা একাডেমি নিজেই এই নিয়মের বাইরে গিয়েছে বারবার। কয়েক জায়গায় লিখেছে, ‘১০ ফেব্রুয়ারি’, কোথাও আবার ‘২০ ফেব্রুয়ারি’ ও ‘২৫ ফেব্রুয়ারি’। অথচ নিয়মানুযায়ী, ‘১০ই ফেব্রুয়ারি’, ‘২০শে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘২৫শে ফেব্রুয়ারি’ লেখার কথা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরে বানানরীতি প্রয়োগে সুনির্দিষ্ট কোনো তদারকি কিংবা সম্পাদনার মানদণ্ড যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে না। এর ফলে ভাষা নির্দেশনা প্রদানে একাডেমির গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খানম বলেন, ‘বাংলা একাডেমিকে সমানভাবে সবাই গ্রহণ করেননি। আমার মনে হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ শিক্ষক বাংলা একাডেমিকে ফলো করে না। তবে যেহেতু বাংলা প্রসারের জন্য একাডেমি কাজ করে যাচ্ছে, তাই তাদের অভিধান অনুযায়ী চলা উচিত বলে আমি মনে করি। আমি নিজেও বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসরণ করি এবং আমার শিক্ষার্থীদেরও অনুসরণ করতে বলি।’

বানানের এমন ভিন্নতার বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, এ ব্যাপারটা অনেকগুলো কারণে ঘটে। একটা হলো, প্রকাশনাগুলো লম্বা সময়ের মধ্যে হয়েছে। অনেকগুলো বানান লম্বা সময়ের মধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে পূর্বের প্রকাশনাগুলোতে আগের বানান রয়ে গেছে।

বাংলা একাডেমি তার কাজের জন্য বিজ্ঞ এবং বাইরের প্রুফরিডার ব্যবহার করেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রুফরিডাররা সবসময় সমতা বিধানের ব্যাপারটা করতে পারেন না। তারপর কোনো কোনো লেখক বিশেষ ধরনের বানান পছন্দ করেন। অনেক সময় তাদের লেখাতে তাদের মতো বিধি রাখতে হয়।

প্রমিত বানানকে পুরোপুরি অধিকতর গ্রহণযোগ্য করা যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো কোনো সময় দেখা যায় বাংলা একাডেমির একাধিক অভিধানে একাধিক ফর্ম আছে। বানানের যে একাধিক ফর্ম আছে, যেগুলো আসলে ভুল নয়। কোনো কোনো সময় বানানের একাধিক ফর্মই শুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু সবগুলোর ফর্ম যদি একরকম রাখা যেত আর বাংলা একাডেমির যে অভিধান তা যদি একরকম করা যেত এবং প্রকাশনাগুলোতে যদি ঐ বানানগুলোই ব্যবহার করা যেত তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হতো।

তার ভাষ্য, এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, সবগুলো বানান ভুল নয়। প্রমিত বানানের ক্ষেত্রে একরকম বানানকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ভাবা হয়‌। সে ধরনের ব্যাপারটা পুরোপুরি করা যায়নি। সেজন্য নিশ্চয়ই আমাদের চেষ্টা করতে হবে, যেন সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারি‌।

বানানের বিশৃঙ্খলা চূড়ান্তভাবে মীমাংসা করা সহজ নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, বাংলা একাডেমির যে বিচিত্র ধরনের কর্মকাণ্ড, সে কর্মকাণ্ড যারা করেন- যেটা তো একজন বা একটা মাপকাঠিতে চালানো সম্ভব না। এগুলো করেন একশ থেকে দুশো লোক।

তাদের মধ্যে নানা ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা মেইনটেইন করা এত সহজ না, বরং কঠিন। পুরো ব্যাপারটা একই রকম করতে পারলে নিশ্চয়ই ভালো হতো। তবে এটা সহজ নয়‌। এগুলো কম হলে বা না-হলে আরো ভালো হতো। এমনিতে আমাদের বানানে কিছু বিশৃঙ্খলা তো আছেই। এগুলো আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে হবে। চূড়ান্তভাবে মীমাংসা করা এত সহজ নয়। এটা নিঃসন্দেহে কমিয়ে আনতে হবে।

‘উদ্বোধন’ বানানের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা ভুল নয়, এটা আসলে মতভিন্নতা। এ ব্যাপারে পণ্ডিতদের মধ্যেও মতভিন্নতা রয়েছে। বাংলা একাডেমি তো আর ইট-কাঠ-পাথরের নাম না, বাংলা একাডেমি তো পণ্ডিতদের সমষ্টি। সেখানে পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে ও থাকবে।