ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


১৯৭১ : ডিসেম্বরেই ঢাকা দখল


২ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:১৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৫:২৯

এই ডিসেম্বর উনিশশত একাত্তরের। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে আবিভূ©ত হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনাধীন পাকিস্তান এই সত্য বিশ্বাস করুক বা না করুক, তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্ট গোপনীয় চিঠি চালাচালিতে স্পষ্টই জেনে গেছে পাকিস্তানের খণ্ডীকরণ ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই। অধিকতর দূরদর্শী কয়েকটি গণমাধ্যম একাত্তরের মার্চের শেষ সপ্তাহেই লিখেছে : লাশের পাহাড়ের নিচে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সমাহিত। একাত্তরের ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের একটি অনূদিত কোলাজচিত্র সৃষ্টি করেছেন আন্দালিব রাশদী। আজ দ্বিতীয় পর্ব

নিরাপত্তা পরিষদে উ থান্টের প্রতিবেদন

জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিরাপত্তা পরিষদে মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে যে সংযোজনী পাঠান, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সংযোজনীর অনুবাদ :

# ৩ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন শেষ করার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে দুটি বার্তা এসে পৌঁছেছে।

# ৩ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে মৌখিকভাবে গ্রহণ করা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বার্তাটি নিমœরূপ : ২ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে ভারতের পাঠানকোট, শ্রীনগর ও অমৃতসরে পাকিস্তানিদের বিমান হামলার পর ৩ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানিরা আরও তিনবার ফরিদকোট (পাঞ্জাব), জয়সালমার (রাজস্থান) ও যোধপুরে (রাজস্থান) বিমান আক্রমণ চালায়।



৪ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্ট বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে।

# আজ মধ্যরাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।

# ভারত পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে বলে পাকিস্তানি সূত্রে যা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে।

# জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি সেক্রেটারি জেনারেলকে পাঠানো প্রেসিডেন্টের বার্তা হস্তান্তর করেছেন। তাতে বলা হয়েছে :

ক. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির প্রতি আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আজ পশ্চিম পাকিস্তানি প্রতি সময় ১৫ : ৩০ এবং ১৬ : ০০-এর মধ্যে ভারতীয় বাহিনী শিয়ালকোট, জেলার ব্রিজ ও লাহোরের মধ্যবর্তী একটি স্থান, পশ্চিম পাকিস্তানের রহিম ইয়ার খান নামক স্থানের উল্টোদিকে রাজস্থান সীমান্তে জম্মু ও কাশ্মীরের চাম্প-এ উপর্যুপরি হামলা করেছে। ভূ-পৃষ্ঠে এই আক্রমণকে সহায়তা দিয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। পশ্চিম সীমান্তে তিন-চার দিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানি ভূখণ্ডের আকাশে ভারতীয় বিমান নজরদারি করেছে।

খ. পাকিস্তানি বাহিনী এই আক্রমণের জবাব দিতে যাচ্ছে।

গ. আজ সন্ধ্যায় ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অবন্তিপুর এবং ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন পাঠানকোট ও অমৃতসরে পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রতিরক্ষামূলক আক্রমণ চালিয়েছে।

ঘ. ভারতীয় বাহিনী ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পুঞ্চ ও উরি সেক্টরে আক্রমণ চালিয়েছে।

ঙ. আপনি অবগত রয়েছেন যে, ভারতের ভয়ংকর প্ররোচনার পরও আমি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের বৃদ্ধি এড়াতে সম্ভাব্য সব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

বিগত সপ্তাহগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় কাহিনীর নগ্ন আগ্রাসন এবং সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে যেভাবে তারা পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করছে, তা যুদ্ধ পরিস্থিতির সমতুল্য। আমরা এ পরিস্থিতি সামনে নিয়ে উত্তেজনা প্রশমনে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এই লক্ষ্যে আমার উদ্যোগগুলো সম্পর্কে আপনি অবহিত রয়েছেন। আমি শেষ প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক ন্যস্ত করার অনুরোধ জানিয়েছি, তারা স্বচক্ষে দেখে ভারতীয়দের আইন অমান্য করা নিয়ে প্রতিবেদন দিক।



চ. ভারতীয় আগ্রাসী আক্রমণে বহুমাত্রিক প্রভাব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে নেওয়া উচিত। নতুবা সমগ্র অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করে কেবল ভয়ংকর পরিণতিই ডেকে আনতে পারে।

সবশেষে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কামনা করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ন্যায় ও শান্তির পক্ষে থেকে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী জাতিগুলোর সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে সাহায্য করবেন।

পাকিস্তানের তখনকার মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কেউই তার চিঠি তেমন গায়ে লাগায়নি।

পাকিস্তানের জন্য চীনের দৃঢ় সমর্থন

৪ ডিসেম্বর লন্ডনে ‘সানডে টাইমস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অস্ত্র সহায়তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল। অবশ্য তিনি বলেন, উপমহাদেশে কেবল যুদ্ধের ড়্গেত্রে চীন পাকিস্তানকে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাবে। তিনি এ দৃঢ় সমর্থনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি। তবে তিনি উপমহাদেশে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের রেখে যাওয়া পূর্ব বাংলা ছিল একটি ‘টাইম বোমা’; চৌ নন-লাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এমনকি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও উপমহাদেশে অস্থিতিশীলতার কাল অব্যাহত থাকবে।

চৌ এন-লাই পূর্ব পাকিস্তান থেকে পলাতক শরণার্থী এবং তিব্বত থেকে ভারতে পলাতক শরণার্থীদের সমান্তরাল দৃষ্টিতে দেখতে চান। তিনি বলেন, চীনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সফরের ঘোষণা হওয়ার পর দুই বছর ধরে ভারত-সোভিয়েত গলাগলি শুরু হয় এবং তাড়াহুড়ো করে ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি সইও হয়ে যায়। ১৯৬২-এর ভারত-চীন দ্বন্দ্বের জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৬২ সালে রুশরা ভারতকে বলেছিল, চীন কখনো বদলা নিতে আসবে না।

সিনেটর এডমন্ড মাস্কির ৪ দফা

৭ ডিসেম্বর ডেমোক্র্যাট সিনেটর এডমন্ড এস মাস্কির বিবৃতি : ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধে বিচারকের আসনে বসে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সাজে না। যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে, পূর্ব বাংলার জনগণের ভোগান্তি শেষ করতে এবং যুদ্ধমান অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শান্তিরক্ষার স্থায়ী পরিবেশ সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও অবদান রাখার এটাই সময়।

অতএব আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, জাতিসংঘের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগ দিয়ে নিচের দাবিগুলো উত্থাপন করুক :



১. সব রণাঙ্গনে এখনই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে পশ্চিম ফ্রন্ট থেকে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে নিজের দেশে নিয়ে যাক।

২. পূর্ব বাংলা থেকে ভারতীয় ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার করে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, শরণার্থী প্রত্যাবাসন তত্ত্বাবধান এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা হোক।

৩. পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তার নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে ও প্রাদেশিক জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় সাময়িক সরকার গঠন করতে হবে।

৪. পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা সমান মর্যাদা ও সক্ষমতা নিয়ে ভবিষ্যতে দুই সত্তার মধ্যে কেমন সম্পর্ক রক্ষা করা হবে, তা নির্ধারণ করবে। বাইরের শক্তির কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ নাকচ করে দিয়ে তারা তাদের মধ্যকার চ‚ড়ান্ত মীমাংসা সম্পন্ন করবেন।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের পূর্ব বাংলায় নিপীড়নের পর পাকিস্তানে অস্ত্রের জাহাজ পাঠানো অব্যাহত রাখার পরও প্রেসিডেন্ট নিক্সন ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’র দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন।

পূর্ব বাংলায় এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর এবং ভারতে প্রায় এক কোটি মানুষকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য করার পরও আমরা সেখানে পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছি, একে কি আর ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’ বলা যায়?

ভারতকে ‘আগ্রাসী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করাই কি স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্রের ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’?

পাকিস্তানের এ ধরনের কার্যক্রমের পর ভারতের জন্য পূর্ব প্রদত্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেওয়া ও
পাকিস্তানের বেলায় তা অব্যাহত রাখা কি ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’?

অস্ত্রবিরতির আহ্বানে পূর্ব বাংলায়, নিপীড়ক পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সেখানে রেখে দেওয়াতেই কি ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’র পরিচয় দেওয়া হবে?

‘সবচেয়ে জরুরি সমস্যা পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ। যতক্ষণ না পূর্ব বাংলার মানুষ তাদের ভবিষ্যতের একটি নিশ্চিত ও স্থায়ী সমাধানের দেখা না পাচ্ছে, ততক্ষণ এই লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটবে না। সেই ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব আমাদের নয়, তবে আমরা সেখানকার জনগণকে সাহায্য করতে পারি, যাতে শান্তিপূর্ণ সমাধান তারা নিজেরাই বের করে নেন।’

টু দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান (১)

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ গভর্নর এ এম মালেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি বস্তুনিষ্ঠ বার্তা পাঠালেন। এটি বেতারবার্তা।

টু দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান-

সামরিক পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। শত্রুরা পশ্চিমে ফরিদপুরের দিকে এগোচ্ছে। শত্রুরা কুমিল্লা ও লাকসামে আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে পূর্বদিক দিয়ে মেঘনা নদী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সব নদীপথ রুদ্ধ করে তারা চাঁদপুর দখল করে নিয়েছে। বাইরের কোনো সাহায্য যদি অবিলম্বে আমাদের কাছে না পৌঁছে, তাহলে শত্রুরা যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছাবে। ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি বেসামরিক জনগণ বিশেষ করে অবাঙালিদের জীবন রক্ষা করার জন্য ঢাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে। এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য আমি জোর সুপারিশ করছি।

প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো দীর্ঘ বেতারবার্তায় গভর্নর আরও বলেন : জেনারেল নিয়াজি এই প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, এ ড়্গেত্রে তার আদেশ হবে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া। তার মানেই ঢাকার পতন।



নিয়াজির পথে এগোলে সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে। তাদের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হবে পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, অবাঙালি নাগরিক এবং (পাকিস্তানের প্রতি) অনুগত স্থানীয় জনগণ। আমাদের রিজার্ভে কোনো নিয়মিত বাহিনী নেই। শত্রুরা একবার গঙ্গা (পদ্মা) বা মেঘনা পাড়ি দিয়ে চলে এলে যদি আজকের মধ্যেই চীন কিংবা আমেরিকা নৌ ও আকাশপথে আমাদের সহায়তা না দেয়, তাহলে প্রতিরোধের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি অনুমোদনের এবং রাজনৈতিক সমাধানের সবিনয় অনুরোধ করছি। অন্যথায় কয়েক দিনের মধ্যেই পূর্বাঞ্চলে ভারতের সৈন্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে এলে পশ্চিমাঞ্চল বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।

আপনি অনুগ্রহ করে অনুধাবন করতে চেষ্টা করুন যে, অধিকৃত এলাকায় স্থানীয় জনগণ ভারতীয় সৈন্যদের স্বাগত জানিয়েছে এবং তাদের সর্বাধিক সম্ভব সহযোগিতা প্রদান করে চলেছে।

বিদ্রোহীদের অভিযান অব্যাহত থাকার কারণে আমাদের সৈন্যরা নিজেদের প্রত্যাহার করে আক্রমণ চালানোর জন্য পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তানিদের এই পক্ষপাতিত্বের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়ছে। গভর্নর মালেকের বার্তা এখানেই শেষ।

প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এই বার্তা বিশেস্নষণ করলে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, গভর্নর মালেকের পাকিস্তানের প্রতি চ‚ড়ান্ত রাজনৈতিক আনুগত্য থাকার পরও (তা না হলে গভর্নরের পদ গ্রহণ করতেন না) বস্তুনিষ্ঠ এবং হত্যাযজ্ঞ ঠেকানোর মতো একটি বার্তাই তিনি দিয়েছেন। তার বার্তা একই সঙ্গে রণাঙ্গনের চিত্রও তুলে ধরে- পাকিস্তানের পতনের আর দেরি নেই।

টু দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান (২)

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে পাঠানো পত্রে গভর্নর এ এম মালেক এবং তার মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রটি অনূদিত হলো :

দেশকে অধিকতর রক্তপাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা গভর্নরের পদ এবং গভর্নরের পরিষদে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলাম; এই পদত্যাগ অবিলম্বে কার্যকর হবে। আমরা সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।

স্বাক্ষর : এ এম মালেক, আবুল কাশেম, এ এস এম সোলায়মান, নওয়াযেশ আহমদ, এ আহমদ, এম ইউসুফ, মো. ইসহাক, মুজিবুর রহমান, জসিমুদ্দিন আহমেদ, মো. ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, এ কে মোশাররফ হোসেন, আব্বাস আলী খান।

উৎফুল্ল জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে

৭ ডিসেম্বর, যশোর, পূর্ব পাকিস্তান :

উৎফুল্ল জনতা বাংলাদেশ সেস্নাগান দিয়ে বিজয়ী ভারতীয় বাহিনীকে অভিনন্দন জানাতে দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছে।

লাল-সবুজ-সোনালি বাংলাদেশ পতাকা, যা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল, তা ওড়াতে ওড়াতে তারা বাড়ি থেকে আবিভূ©ত হয়েছে; পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি আসবে এই আতঙ্কে যেসব নারী ধান ড়্গেতের গভীরে লুকিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে।



একটি আচমকা ধাক্কাতেই সেখানকার পাকিস্তানি বাহিনীকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিলে তাদের পালিয়ে যেতে হয়। ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি সশব্দে অধিকাংশ তালাবন্ধ, শাটার নামানো দোকানের সামনে দিয়ে চলে যায়।

পাগড়িবাঁধা শিখ এবং বাদামি মুখমণ্ডলের গোর্খা রাইফেলধারীরা জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে সানন্দে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের সেস্নাগান ‘জয় বাংলা’ দিতে থাকে।

যশোরে যারা বেঁচে আছেন, শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়া ছিল তাদের লালিত স্বপ্নের চেয়েও বেশি।

রাস্তায়ও মুক্তিবাহিনী, জাতীয়তাবাদী গেরিলা, যারা আট মাস ধরে প্রেসিডেন্ট এ এম ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ এবং অ্যামবুশ করে তাদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে।

তাদের কাঁধে ঝুলছে ভারতের সরবরাহ করা আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল; তাদের গোপন ক্যাম্পে জঙ্গলে কিংবা কলার বনে রয়েছে মর্টার এবং লাইট মেশিনগান।

যশোর যুদ্ধে তাদের ভূমিকা কম থাকলেও তাদের হাঁটার ভঙ্গি ছিল সদম্ভ- তারা বিজয়ের এ দিনটিকে উপভোগ করছে।

ভারতীয় মেজর জেনারেল দলবীর সিং, যার বাহিনী যুদ্ধ করে এই শহর জয় করেছে তিনি বললেন, যদি পাকিস্তানি বাহিনী মাথা খাটিয়ে যুদ্ধে নামত, তাহলে আমাদের এক মাস ধরে যুদ্ধ করতে হতো।

ভারতীয় নবম ডিভিশনের কমান্ডার জেনারেল সিং বলেন, একটি ট্যাংক ঠেকানো পরিখা এবং ছোট ম্যাজিনট লাইন (প্রতিরোধক ব্যবস্থা) থাকলেও তার বাহিনী প্রায় বাধাহীনভাবেই শহরে ঢুকতে পেরেছে।

কলকাতায় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র যশোর জয়ের যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে জেনারেল সিংয়ের কথার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মুখপাত্র বলেছেন, যশোরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের তীব্র লড়াই হয়েছে।

যেটুকু লড়াই হয়েছে, তার সবটাই শহরের বাইরে। জেনারেল সিং বলেছেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা এপ্রিল থেকে লড়াই করে আসছে, তবুও তারা যথেষ্ট অসংঘটিত।

কোনো কোনো বাড়ির ওপর শেলের আঘাত লেগেছে। এ ছাড়া যশোরের অতি সামান্যই ক্ষতি হয়েছে।

অধিকাংশ পাকিস্তানি সৈন্য নিজেদের প্রত্যাহার করে বন্দর ও কারখানার শহর চালনার দিকে রওনা হয়েছে।

‘আমি তাদের কজনকে এক জায়গায় পেয়ে গেছি, বাকিদেরও পালানোর কোনো সুযোগ নেই’- জেনারেল দলবীর সিং বললেন, ‘আমি তাদের কাউকে হত্যা করতে চাই না, কেবল ধরতে চাই। আমি ভদ্র প্রকৃতির মানুষ।’ (বাল্টিমোরের ‘দ্য সান’-এ প্রকাশিত)

আগামীকাল শেষ পর্ব