ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


শাস্তি হয়নি কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের,

নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের অনিয়মে বাধা দেওয়ায় পিডিকে বদলি!


২ এপ্রিল ২০২১ ০৯:০৭

আপডেট:
২ এপ্রিল ২০২১ ০৯:১৫

শীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ।ভবিষ্যতে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে রেলওয়ের বহরে ২২০০ হর্স পাওয়ারের ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন  কিনেছে রেলওয়ে। এজন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি হয় রেলওয়ের।  কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২২০০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিনের জন্য তিন হাজার কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর সরবরাহের কথা থাকলেও তা হয়নি। জেনারেটরও দেওয়া হয়েছে ২২০০ কেভিএ। এ গত বছর আগস্টে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি। তবে দরপত্রের শর্তানুসারে ইঞ্জিনগুলোয় বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এসব ইঞ্জিন। এজন্য হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তবে এক মাস পেরিয়ে গেলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

শাস্তি হয়নি কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের, পিডিকে বদলি রেলওয়েকে নিম্নমানের ১০টি ইঞ্জিন সরবরাহ

এদিকে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ করায় হুন্দাই রোটেমের বিল আটকে রাখে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নূর আহম্মদ হোসেন। এতে তার ওপর অসন্তুষ্ট হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা। নানাভাবে চাপ দিয়েও বিল ছাড় করানো ও ইঞ্জিন গ্রহণে পিডির অবস্থান পরিবর্তন না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে বদলিই করে দেয়া হয়েছে। গতকাল রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত ১০ ইঞ্জিন বুঝে নেয়া এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেমকে দায় মুক্তি ও বিল প্রদান করতে পিডি পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটির নতুন পিডি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মো. হাসান মনসুরকে, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে।এজন্য সম্প্রতি তার পদোন্নতি ও রেলওয়ের মহাপরিচালক হওয়া আটকে যায়।

সূত্রমতে, কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ করলে তা গ্রহণে আপত্তি তোলেন পিডি নূর আহম্মদ। তবে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের নির্দেশে তা খালাস করে পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে রাখা হয়। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্ত কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাতে পরিবর্তন আনা হয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়। রেলপথ সচিবের কাছে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও তা এক মাসের বেশি সময় ধরে গোপন করে রাখা হয়েছে।

যদিও তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি এই রিপোর্টারের হাতে এসে পড়ে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, রেলের ১০টি ইঞ্জিন কেনায় ২০১৮ সালের ১৭ মে হুন্দাইয়ের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরের সিসিআইসিকে নিয়োগ করা হয়। চুক্তির শর্তানুসারে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন প্রতিবেদন (পিএসআই) প্রদান করার কথা ছিল সিসিআইসির।

তবে ১২ আগস্ট সিসিআইসি যে প্রতিবেদন দাখিল করে তাতে বলা হয়, ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশে আসার পর কমিশনিং পিরিয়ডে টেস্টিং ও ট্রায়াল রান সন্তোষজক হতে হবে বলে শর্ত দেয়া হয়। আবার একই তারিখে সিসিআইসি শর্তবিহীন আরেকটি পিএসআই সার্টিফিকেট দাখিল করে। একই দিনে দুই ধরনের পিএসআই প্রতিবেদন দেয়ায় ইঞ্জিন গ্রহণে আপত্তি তোলেন পিডি নূর আহম্মদ। তবে ইঞ্জিনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর যথাসময়ে খালাস না করলে জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে অজুহাত দেখিয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তা খালাস করে পাহাড়তলী ডিজেল ওয়ার্কশপে রাখা হয়।

এদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক গঠিত কমিশনিং কমিটি ইঞ্জিনগুলোর টেস্টিং, ট্রায়াল রান ও কমিশনিং সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে ইঞ্জিনের কারিগরি শর্ত তথা অলটারনেটর, কম্প্রেসর, ট্রাকশন মোটর এ চারটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টস চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি বলে উল্লেখ করে। ফলে ইঞ্জিনের ব্রেক হর্সপাওয়ার ২২০০বিপিএইচ ও ট্রাকশন হর্সপাওয়ার ২০০০টিএইচপি হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় ২১৭০ ও ১৯৪২এইচপি।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০ জানুয়ারি তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য পেশ করে হুন্দাই রোটেম। এতে তারা অলটারনেটর, ট্রাকশন মোটর ও ইঞ্জিনে কিছুটা পার্থক্য আছে বলে উল্লেখ করে। এছাড়া ৭ জানুয়ারি সিসিআইসির কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইলে তারাও কিছুটা পার্থক্যের কথা জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি ইঞ্জিনগুলো সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ পেশ করে।

এতে বলা হয়, রেলওয়েকে সরবরাহকৃত ১০ ইঞ্জিনে অলটারনেটর, ইঞ্জিন ও ট্রাকশন মোটরের মডেলের ভিন্নতা রয়েছে। হুন্দাই রোটেম চুক্তি ভঙ্গ করে এগুলো সংযোজন করেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আর প্রি-শিপমেন্ট এজেন্ট সিসিআইসি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেনি। তাই তাদের বিরুদ্ধেও চুক্তি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

যদিও এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও হুন্দাই রোটেম বা সিসিআইসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো ইঞ্জিনগুলো চালানো সম্ভব কি না, তা যাচাইয়ে আরেকটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয় গত ২৩ মার্চ। তবে ওই কমিটি কাজ শুরুর আগেই পিডিকে বদলি করে দিল রেলপথ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে জানতে রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পাশাপাশি এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি। পরে গতকাল তার দপ্তরে গিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে সচিবের সঙ্গে দেখা করা ও মন্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি দেখা করতে ও মন্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।

এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া গতকাল তার দপ্তরে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, গত ৯ ডিসেম্বর ‘রেলওয়ের ১০ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম: নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় । পরে ১৮ জানুয়ারি ‘রেলের নিম্নমানের ১০ ইঞ্জিন কেনা: প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিটি, হুন্দাই রোটেমের অসহযোগিতা’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আর সর্বশেষ ৬ মার্চ ‘রেলওয়েকে নিম্নমানের ১০টি ইঞ্জিন সরববরাহ: দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ’ শীর্ষক তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।