বিসিএস ক্যাডার হয়েও বেকার ৩১,৮৭৪
বিসিএস উত্তীর্ণ। কিন্তু চাকরি মেলেনি। ক্যাডার বা নন-ক্যাডার, কোনোটাই নয়। এ সংখ্যা এক-দুজন নয়, ৩১ হাজার ৮৭৪ জন। কেউ হয়তো নামকাওয়াস্তে অন্য চাকরি করছেন। কিন্তু তা দিয়ে প্রয়োজন মিটছে না। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারের শূন্য পদের সংখ্যা কখনোই দুই লাখের নিচে নামেনি। বর্তমানে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৫ হাজার। শূন্য পদ পূরণ এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের চাকরির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ২৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ শুরু করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের হার খুবই কম। অথচ বিসিএসে নন-ক্যাডার যুক্ত করা হয়েছিল বিসিএস উত্তীর্ণদের মতো মেধাবীদের চাকরির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ক্যাডার পদে সুপারিশ করার পর বিসিএস উত্তীর্ণ অবশিষ্ট প্রার্থীদের জন্য নন-ক্যাডার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে ক্যাডার পদে ডাক না পাওয়া বিসিএস পাস প্রার্থীদের প্রায় সবাই আবেদন করেন। এর আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে শূন্য পদের সংখ্যা জানতে চায় পিএসসি। কিন্তু পিএসসিকে শূন্য পদের প্রকৃত তথ্য না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে শূন্য পদের সংখ্যা না কমে দিন দিন বাড়ছে।
সরকার যে সময় ২৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদ্ধতি চালু করে তখন বিসিএস উত্তীর্ণ হয় ৫ হাজার ১০৫ জন। তাদের মধ্যে ক্যাডারে সুপারিশ পান ২ হাজার ১৯০ জন। ধাপে ধাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন ২৯৮ জন। ক্যাডার বা নন-ক্যাডার কোনো পদেই সুপারিশ পাননি ২ হাজার ৬১৭ জন।
একইভাবে ২৯তম বিসিএসে ৩ হাজার ১৪৭, ৩০তমে ৩ হাজার ৮০, ৩১তমে ৩ হাজার ২৯৭, ৩২তমে ১ হাজার ৪৪, ৩৩তমে ৯ হাজার ২৭১, ৩৪তমে ৪ হাজার ৩৩১, ৩৫তমে ১ হাজার ৩৫৫, ৩৬তমে ২ হাজার ২১ এবং ৩৭তমে ১ হাজার ৭১১ জন ক্যাডার বা নন-ক্যাডার কোনো পদেই সুপারিশ পাননি। সুপারিশ না পাওয়াদের মোট সংখ্যা ৩১ হাজার ৮৭৪ জন। ৩৮তম বিসিএসের নন-ক্যাডারে এখনো নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পর নন-ক্যাডারেও ডাক না পাওয়ায় চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। ইতিমধ্যে বিসিএসে নন-ক্যাডার অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিসিএস পাস কিন্তু নন-ক্যাডার বঞ্চিতরা। তারা নন-ক্যাডারমুক্ত ‘মৌলিক বিসিএস’ দাবি করছেন।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেছেন, ‘বিসিএসে নন-ক্যাডার যুক্ত করার বিষয়টি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে মেধাবীদের নন-ক্যাডারে চাকরি হচ্ছে। দপ্তরগুলো কোয়ালিটি কর্মী পাচ্ছে। এর কোনো সমস্যা থাকলে তা নিশ্চয়ই সমাধান করা হবে।’
বিসিএস উত্তীর্ণ নন-ক্যাডার পদে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মরত একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, তিনি ৩৩ থেকে ৩৮তম বিসিএসের প্রতিটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে সবগুলো লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। দুবার মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে একবার নন-ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, তিনি চাকরি পেলেও তার অনেক ব্যাচমেট নন-ক্যাডারের প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো চাকরিই পাননি। তাদের অনেকে বেসরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন। টিউশনি করে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। বিসিএস উত্তীর্ণ করেন মেধাবীরাই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রিলিমিনারিতেই ঝরে পড়েন প্রায় সবাই। এরপর লিখিত ও মৌখিকে দুর্বলদের ঝেড়ে ফেলা হয়।
তিনি জানান, এত প্রক্রিয়ার পর যারা বিসিএস পাস করেন তাদের নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশের জায়গা থাকে না পিএসসির। অথচ যে দপ্তরেই হাত দেবেন সেখানে দেখতে পাবেন জনবল ঘাটতির কথা। নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডের কারখানায় আগুন লাগার পর তদারকি সংস্থার কর্মকর্তারা বললেন যে নিয়মিত তদারক করার মতো জনবল নেই তাদের। ঢাকায় ভবন ধসে পড়লে রাজউক বলে জনবল ঘাটতির কথা। অথচ শূন্য পদের অভাবে বেকার থাকতে হয় বিসিএস উত্তীর্ণদের। বিষয়টি খুব হতাশার।
সরকার যখন বিসিএস উত্তীর্ণদের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি শাখার অতিরিক্ত সচিব ছিলেন ফিরোজ মিয়া। তিনি সরকারের এ ভাবনা বাস্তবে রূপ দেন। শুরুতে এ সংস্কার নিয়ে সরকারের ভেতরে প্রচন্ড মতবিরোধ ছিল। কিন্তু বিধিমালা করে বিষয়টি বাস্তবে রূপ দেওয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ফিরোজ মিয়া।
এক প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ মিয়া
বলেন, ‘বিসিএস উত্তীর্ণদের নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল চাকরির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক। কিন্তু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে সরকার খুব বেশি বিসিএস উত্তীর্ণদের চাকরি দিতে পারছে না। এর কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হলে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, দপ্তরের কর্মকর্তারা ঘুষ নিতে পারেন না। এ কারণে তারা সরকারকে শূন্য পদের যথাযথ হিসাব দেয় না। সরকারের উচিত সব বিসিএস উত্তীর্ণকে ডেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া। এতে চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমবে।’
বিসিএসের গুরুত্ব দিন দিনই বাড়ছে। চলমান মহামারীতে এর গুরুত্ব অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রমাণিত হয়েছে। সরকারি চাকরি ছাড়া আর সব পেশায় ধস নেমেছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মী ছাঁটাই করে, বেতন কমিয়ে দিয়ে বেসরকারি অনেক সংস্থা টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
একটি নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে চাকরি করেন আবদুল গফুর। তার স্ত্রী আইনজীবী। এ করোনায় তাদের দুজনের আয় বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামের বাড়ি থেকে জায়গা-জমি বিক্রি করে বাসা ভাড়া দিয়ে টিকে ছিলেন রাজধানীতে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম সরকারি চাকরি। বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসের চাকরি। এখানে চাকরি হারানোর ভয় নেই। আছে নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে বসার সুযোগ। আছে নিশ্চিত পদোন্নতির হাতছানি। মহামারীতে অন্য শ্রেণির পদোন্নতি না হলেও ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয়েছে নিয়মিত। করোনাকালে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে।
আগে এসএসসি বা এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় যারা বোর্ডে স্ট্যান্ড করত তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে মাতামাতি ছিল। খবরের কাগজে তাদের ছবি ছাপা হতো। ফার্স্ট স্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থীরা বড় হয়ে কী হতে চান তা নিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। কালক্রমে পদ্ধতিগত কারণে সেই মাতামাতি আর নেই। এখন মাতামাতি হয় বিসিএস পরীক্ষা ক্যাডার পদে সুপারিশ পাওয়াদের নিয়ে। তারা যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পান তখন তাদের নিয়ে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব থাকে। অভিনন্দন জানানোর ঝড় ওঠে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের মতে, সরকারি চাকরিতে এখন অনেক বেতন। বেতনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা থাকায় তরুণ সমাজ বিসিএসে ঝুঁকছে।
তবে নানা বাধা পেরিয়ে নন-ক্যাডারে চাকরি পেয়েও স্বস্তিতে নেই বিসিএস উত্তীর্ণরা। চাকরিজীবনেও তাদের নানা বাধার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান পিএসসি থেকে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্তরা। পিএসসি কিছু কিছু নন-ক্যাডার পদে সরাসরি নিয়োগের সুপারিশ করে। তাদের পরীক্ষা দিতে হয় ৩০০ নম্বরের। অথচ বিসিএস পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি, তারপর ৯০০ নম্বরের লিখিত এবং ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়।