ঢাকা মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১


জমির পরিমাণ অনুযায়ী ঘুষ নির্ধারণ করেন এসিল্যান্ড


২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:২০

আপডেট:
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:০৩

কুমিল্লার লালমাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাছরীন আক্তার। নিজেই কাজের ধরন ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী ঘুষের হার নির্ধারণ করে দেন। পদ অনুযায়ী ঘুষের টাকার ভাগ কে কত পাবে সেটাও নির্ধারণ করেন তিনি। তার এসব অপকর্মের নিয়ন্ত্রণ করতে মৌখিকভাবে দায়িত্ব দিয়েছেন অফিস সহায়ক শাহ আলমকে। এমনি সব নানা অনিয়ম-দুনীতি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা ভূমি অফিসের জারিকারক মো. খোরশেদ আলম প্রকাশ্যে একজন সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে চার হাজার টাকা (১ হাজার টাকার ৪টি নোট) ঘুষ গ্রহণ করছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকা গুনে নিজের ব্লেজারের পকেটে রেখেছেন। এরপর তিনি3 সেবাগ্রহীতাকে বলছেন, আপনি চলে যান। নামজারি হয়ে গেলে আমি আপনাকে জানাব।

ঘুষের লেনদেনের বিষয়টি এই প্রতিবেদকের নজরে আসায় খোরশেদ আলম কিছুটা বিচলিত হয়ে বলেন, ডিসিআর কাটতে ১১৭০ টাকা নিয়েছি। কিন্তু অফিসের দেয়ালে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা দেখিয়ে টাকার পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে চুপ হয়ে যান।

এ বিষয়ে সেবাগ্রহীতা কৃষক আবুল কাশেম বলেন, গত মাসে আমি এক শতক নাল জমি নামজারির জন্য আবেদন করেছিলাম। খোরশেদ আলম ভাই আমার কাছে মোট সাত হাজার টাকা চেয়েছিলেন। আমি বলেছি সাত হাজার নয়, ছয় হাজার টাকা দেব। সেদিন আমি দুই হাজার টাকা দিয়ে গেছি। আর বাকি চার হাজার টাকা শাহ আলম ভাইকে দিয়েছি। এখন তিনি বলছেন- নামজারি হয়নি। দুয়েকদিন পরে আমাকে কল দিলে আবার অফিসে আসবেন।

ঘটনাটি সাংবাদিকরা জানার পরে খোরশেদ ভাই আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে ঘুষের চার হাজার টাকা ফেরত দিয়েছে এবং নামজারির অনলাইন কপিও পেয়েছি। তবে আমি চাই, ভূমি অফিসে ঘুষের লেনদেন চিরতরে বন্ধ হোক।

আবার কৃষকের ওই নামজারিতে দেখা যায়, তিনি গত বছরের ২০ ডিসেম্বর উপজেলার সিধুচী মৌজায় ক্রয়কৃত এক শতক নাল জমি পুরনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নিজের নাম খতিয়ানে স্থাপন করতে আবেদন করেছেন। বাগমারা ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. আবদুল মালেক প্রস্তাবিত খতিয়ানে স্বাক্ষর করেন গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর। উপজেলা সার্ভেয়ার স্বাক্ষর করেছেন গত ৯ জানুয়ারি। আর এসিল্যান্ড খতিয়ানটি অনুমোদন করেছেন ১৮ জানুয়ারি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূমি অফিসের একাধিক কর্মচারী বলেন, আমরা ছোট পদে চাকরি করি। বড়দের সিদ্ধান্তে আমাদের চলতে হয়। প্রতি নামজারিতে এসিল্যান্ড ম্যাডামকে ২২০০ টাকা ও নাজিরকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। এটা অফিসের সিদ্ধান্ত। তাছাড়া ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ (ডিসিআর) কাটতে ১১৭০ টাকা লাগে। সেবাপ্রার্থী থেকে ছয় হাজার টাকা নিলে সব খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা আমরা কর্মচারীরা ভাগ করে নিই। প্রতিজনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই।

উপজেলার একটি ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগের এসিল্যান্ড স্যারেরা প্রতি নামজারিতে ১ হাজার টাকা করে নিতেন। বর্তমান এসিল্যান্ড ম্যাডাম যোগ দেওয়ার পর রেট বাড়িয়ে ২২০০ টাকা করেছেন। জমির পরিমাণ বাড়লে ম্যাডামের টাকার রেটও বেড়ে যায়। তখন সাধারণ মানুষ থেকে বেশি টাকা নিতে গেলে আমাদের বিপদে পড়তে হয়। তবে খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে তিনি অফিস সহায়ক শাহ আলম ও মো. কাউছার আল রোমেনের মাধ্যমে চুক্তি করে টাকা নেন।

ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমান এসিল্যান্ড নাছরিন আক্তার ৩৬তম বিসিএসের একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর লালমাই উপজেলায় যোগদান করেছিলেন। তার কর্মকালে লালমাইয়ে ১০ হাজারের বেশি নামজারি সম্পন্ন হয়েছে।

এ বিষয়ে অফিস সহায়ক শাহ আলমের ফোনে একাধিকবার কল দিও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। অভিযুক্ত জারিকারক মো. খোরশেদ আলম বলেন, আবুল কাশেকে চার হাজার টাকা ফেরত দিয়েছি। নামজারিও করে দিয়েছি। ওনার বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাছরীন আক্তারের সরকারি নম্বরে কল দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌমিতা দাশ  বলেন, ভুক্তভোগীদের আমার কাছে পাঠিয়ে দেন, তাদের বক্তব্য শুনি। তদন্ত করে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, বিষয়টি আমি আপনার মাধ্যমে জানলাম। তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

উপজেলার একটি ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগের এসিল্যান্ড স্যারেরা প্রতি নামজারিতে ১ হাজার টাকা করে নিতেন। বর্তমান এসিল্যান্ড ম্যাডাম যোগ দেওয়ার পর রেট বাড়িয়ে ২২০০ টাকা করেছেন। জমির পরিমাণ বাড়লে ম্যাডামের টাকার রেটও বেড়ে যায়। তখন সাধারণ মানুষ থেকে বেশি টাকা নিতে গেলে আমাদের বিপদে পড়তে হয়। তবে খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে তিনি অফিস সহায়ক শাহ আলম ও মো. কাউছার আল রোমেনের মাধ্যমে চুক্তি করে টাকা নেন।

ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমান এসিল্যান্ড নাছরীন আক্তার ৩৬তম বিসিএস এর একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর লালমাই উপজেলায় যোগদান করেছিলেন। তার কর্মকালে লালমাইয়ে ১০ হাজারের বেশি নামজারি সম্পন্ন হয়েছে।

জারীকারক মো: খোরশেদ আলম ঘটনার দিন বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, আবুল কাশেম সাহেবকে চার হাজার টাকা ফেরত দিয়েছি। নামজারিও করে দিয়েছি। ওনার বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সহকারি কমিশনার (ভুমি) নাছরীন আক্তারের সরকারি নম্বরে ঘটনার দিন থেকে পর পর তিন দিন একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ঘুষের লেনদেনের বিষয়টি উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।