ঢাবিতে ‘জলনিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন: স্থানীয় জ্ঞান, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘জল নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন: স্থানীয় জ্ঞান, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
৬ ডিসেম্বর ২০২৫ শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের অর্থায়নে এবং ঢাবির সেন্টার ফর কালচার এন্ড রিজিলিয়েন্স স্টাডিজ এর সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ এই আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী মো. ওয়ালিউল হক, ডব্লিউএসসিসি গবেষণা প্রকল্পের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলাম ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড তৈয়বুর রহমান। অনুষ্ঠানে মূল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ এর উদেষ্টা ড. আইনুন নিশাত। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন নেপালের পাঠান একাডেমি অব হেলথ সায়েন্সেস এর স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক মধুসূদন সুবেদী এবং ওয়াটার রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট আফ্রিকা এর ওয়াটার প্রোগ্রাম এসোসিয়েট ড. জাবলান আদানে।
স্বাগত বক্তব্য দেন সম্মেলনের আহ্বায়ক ড. তারেক আহমেদ, উদ্বোধনী বক্তব্য দেন সেন্টার ফর কালচার এন্ড রিজিলিয়েন্স এর পরিচালক ও ডব্লিউএসসিসি এর গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক হাসান শাফি।
অনুষ্ঠানে আলোচকদের কথায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে কোন ধরণের প্রভাব পড়ছে এবং এ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের অর্জিত জ্ঞান কীভাবে বৈশ্বিক পরিবর্তন সমস্যার সমাধান করতে পারে তা উঠে আসে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নারীরা মারাত্মক জলসংকটে ভুগছেন- এমন বাস্তবতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে জলবায়ু ন্যায্যতা, প্রযুক্তি সহায়তা ও ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার আহবান জানান তিনি।
তিনি বলেন, পরিবারে পানির যোগানদাতা হিসেবে নারীরাই প্রধান দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু উপকূলে এমন সব এলাকা রয়েছে যেখানে টানা তিন-চার দিন নারীরা গোসল করার মতো পর্যাপ্ত পানি পান না। পরিবারকে নিরাপদ পানীয় জল এনে দিতে তাদের কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়, এতে তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে এবং ঘরে সন্তানরা থাকে অনিরাপদ পরিবেশে।
উপদেষ্টা বলেন, উপকূলীয় কিশোরীরা মাসিক নিয়ে আতঙ্কে থাকে। অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি খেয়ে মাসিক দুই-তিন মাসে একবারে নামিয়ে আনে, শুধুমাত্র পানির অভাবে নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে না পারার কারণে। গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ই–ক্ল্যাম্পসিয়ার মতো জটিলতা বাড়ছে, যা এখন সেখানে সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রিজওয়ানা হাসান জানান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি দাতা দেশগুলো পালন করছে না। নতুন ও অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তার কথা থাকলেও বাস্তবে অনেক দেশ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে যে দুর্ভোগ বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সৃষ্টি নয়, সেই দুর্ভোগ মোকাবিলার জন্যও তাদের ঋণ নিতে হচ্ছে-যা ‘দ্বিগুণ শাস্তি’ বলে মন্তব্য করেন বক্তারা।
বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশটি সব নদীর নিম্নগতিতে থাকা ‘লোয়ার রিপেরিয়ান’ হওয়ায় সীমান্তবর্তী নদীগুলোর পানিবণ্টন আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাথে জড়িত। উজানের দেশগুলো প্রয়োজনের সময় পানি দিতে অনীহা দেখালেও বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ঢুকিয়ে দেয়, এতে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। শুষ্ক মৌসুমে দেখা দেয় পানির ঘাটতি। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের ট্রান্স-বাউন্ডারি ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট কনভেনশন ২০২৪ সালে কার্যকর হলেও বহু উজানের দেশ এখনো স্বাক্ষর করেনি। বাংলাদেশ যদিও এখনো এই কনভেনশনে যোগ দেয়নি, তবে ইউরোপকেন্দ্রিক আরেকটি পানি–বণ্টন সংক্রান্ত ইউএন কনভেনশনে ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছে, যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আলোচনার নতুন প্ল্যাটফর্ম দিতে পারে।
তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিমালয়ে যা ঘটছে বা গঙ্গা অববাহিকায় যা ঘটছে-তা আন্তঃসীমান্ত দেশগুলোকেই সমানভাবে প্রভাবিত করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশই শিগগিরই ‘ওয়াটারলেস কান্ট্রি’ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কোনো দেশ যদি পানিশূন্য হয়ে পড়ে, তার জনগণ বাধ্য হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পানি খুঁজতে যাবে-যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই পানি ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সমন্বয় জরুরি।
বাংলাদেশ সরকার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (রেইনওয়াটার হারভেস্টিং) ও নদী–খাল পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানান উপদেষ্টা। উপকূলে ছোট আকারে স্বল্প খরচে ডেস্যালিনেশন প্ল্যান্ট চালু করা হচ্ছে, যেখানে স্থানীয় নারীরাই ব্যবস্থাপনা করবেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, অভিযোজনের একটি সীমা আছে। উন্নত দেশগুলো যদি সময়মতো এবং কার্যকরভাবে কার্বন নিরসনের (mitigation) পদক্ষেপ না নেয়, তবে যত অর্থই আসুক না কেন ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো অভিযোজনে সক্ষম হবে না। বিশাল অংশ পানিতে তলিয়ে গেলে কিংবা মালদ্বীপের মতো দেশ অস্তিত্ব হারালে কোনো অর্থই সেই ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে না।
তিনি আরো বলেন, “আজ শুধু পানি নিরাপত্তা নয়, এটি পানি ন্যায্যতার প্রশ্ন। উন্নয়ন প্যারাডাইম, ভোগের ধরন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বদলাতে না পারলে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।”
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, আমি আশা করছি এই সম্মেলন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই যেকোন সংকটে সবার আগে এগিয়ে আসে এবং জলবায়ুর এই সংকটেও এগিয়ে আসবে।
মূল আলোচক অধ্যাপক ড আইনুন নিশাত জানান, ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য বাংলাদেশের অবদান ০.৪৭ %। প্রধান কালপ্রিট হচ্ছে চীন, আমেরিকা।
