ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা ঝুঁকছেন অন্য পেশায়


১০ জুলাই ২০২১ ২০:২৫

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৮

২০১৮ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বারে আইন পেশা শুরু করেন এক তরুণ। এ পেশার শুরুতে একটু চ্যালেঞ্জ থাকে, সেটি জানতেন তিনি। তবে করোনাভাইরাস মহামারী সেই চ্যালেঞ্জকে যে এতটা কঠিন করে তুলবে সেটি ধারণাতেও ছিল না নবীন এ আইনজীবীর। দেড় বছর ধরে আদালতের বিচার কার্যক্রমে চলছে একপ্রকার অচলাবস্থা। আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। তরুণ এই আইনজীবী  বলেনÑ বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। যাত্রাবাড়ীতে যে বাসাটায় থাকেন মাসে তার ভাড়া গুনতে হয় ১৫ হাজার টাকা। গত দু’মাস ধরে ভাড়া বাকি পড়েছে। ছোট শিশুটির জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন থাকলেও সেটি দিতে পারছেন না। আছে প্রতিদিনের সংসারের খরচের ঝক্কি। পেশাগত সম্মান ও সামাজিক মর্যাদার কারণে কারও কাছে হাত পাততে পারেন না।

নবীন এ আইনজীবীই শুধু নন, এ পরিস্থিতি এখন উচ্চ আদালতসহ দেশের বিভিন্ন বারের (আইনজীবী সমিতি) হাজার হাজার আইনজীবীর। উচ্চ আদালত ও জেলা বারগুলোতে বার কাউন্সিলের সনদভুক্ত আইনজীবী রয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে মামলা পরিচালনায় যুক্ত। এশিয়ার বৃহত্তম বার খ্যাত ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে প্র্যাকটিস করেন ২০ হাজারেরও বেশি আইনজীবী। আইনজীবী নেতারা বলছেন, পাঁচ ভাগ আইনজীবী সরকারি আইন কর্মকর্তা হিসেবে বেতনভুক্ত। অন্যদের আয় নির্ভর করে প্রতিদিনের মামলার কার্যক্রমের ওপর। তাদের অনেকের আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। করোনার প্রভাবে আদালতের কার্যক্রম অনিয়মিত ও সীমিত হয়ে পড়ায় তরুণ ও নবীন আইনজীবীসহ অসংখ্য আইনজীবী বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক সংকটে ভুগছেন তারা। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের (যারা এখনো বার কাউন্সিলের সনদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি) অবস্থা আরও করুণ। বার কাউন্সিলের অনিয়মিত পরীক্ষা ও করোনাকালীন সংকটে তাদের অন্য পেশায় অনেকেই এখন ঝুঁকেছেন ভিন্ন পেশায়।

বিরূপ এ সময়ে আইনজীবীদের অনেকেই ভালো নেই উল্লেখ করে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন বার থেকে আইনজীবীদের অনেকেই নিজেদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরছেন। বিপাকে পড়া আইনজীবীদের জন্য কী করা যায় এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তিনি।

করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর মার্চের শেষ দিকে আদালতের সব বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুধু ভার্চুয়ালি জামিন শুনানি হয়। চার মাস বন্ধ থাকার পর আদালতের কার্যক্রম আবার শুরু হলেও গত বছরের শেষ এবং চলতি বছরের শুরুর দিকে নিয়মিত আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু বিচারাঙ্গনে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে ফের বন্ধ হয়ে যায় বিচারিক আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম। এরপর ১২ এপ্রিল থেকে শুধু ভার্চুয়ালি জামিন শুনানি চলে। আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর গত ২০ জুন বিচারিক আদালতের নিয়মিত বিচার কার্যক্রম চলার অনুমতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। কিন্তু সংক্রমণ আবারও বেড়ে যাওয়ায় ১০ দিনের মাথায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিচার কার্যক্রম আবারও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুর্দশায় পড়া আইনজীবীরা আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে ভর করেছে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা।

ঢাকা বারের তরুণ আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম  বলেন, ‘গত দেড় বছরে অনেক আইনজীবীকে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। বিশেষ করে নিকট অতীতে এ পেশায় আসা আইনজীবীরা করোনার প্রভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছেন। রোজগার না থাকায় অনেকেই স্ত্রী, সন্তান, পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার কারণে অনেকেই নিশ্চুপ। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকেই হয়তো আর্থিকভাবে সচ্ছল। কিন্তু তরুণ আইনজীবীরা কেবল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। সব মিলিয়ে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী কেউই ভালো নেই।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে  বলেন, ‘অনেক আইনজীবী পেশাগত অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। গত বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে কি ঢাকায় বসে একজন তরুণ আইনজীবীর পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব? কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। আদালত খুললে আসবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আদালত ও বিচার ব্যবস্থা যেমন একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য বিষয় আইনজীবীরাও তাই। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে আইনজীবীরা ভালো নেই। সর্বোচ্চ আদালতে আইন পেশায় থেকেও যদি কাউকে অনিশ্চয়তায় ও আর্থিক সংকটে পড়তে হয় তাহলে সেটি তো কষ্টদায়ক।’

এদিকে বার কাউন্সিলের অনিয়মিত পরীক্ষা ও করোনাকালীন সংকটে বিচার কার্যক্রম অনিয়মিত হয়ে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন অসংখ্য শিক্ষানবিশ আইনজীবী। ঢাকা বারসহ দেশের বিভিন্ন বারে তারা জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে থেকে আদালতে মামলা পরিচালনা সম্পর্কে অবগত হন। তাদের রোজগারের বিষয়টি নির্ভর করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট চেম্বারের আয়ের ওপর। কিন্তু দেড় বছর ধরে তাদের জন্য পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূল। তেমনই একজন তরুণ মৌলভীবাজারের পঙ্কজ দেব। আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করে ২০১৬ সালে ঢাকা বারে একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর অধীনে প্র্যাকটিস শুরু করেন তিনি। হতাশ পঙ্কজ দেব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এমনিতেই বার কাউন্সিলের অনিয়মিত পরীক্ষা ও কঠিন পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে আমার মতো অনেকেই মানিয়ে নিতে পারছেন না। এখন দীর্ঘদিন ধরে করোনার কারণে আদালতে অনিয়মিত। সব মিলিয়ে এই পেশায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। আপাতত শ্যামলীতে ভাইয়ের চশমার শোরুমে বসে ব্যবসা দেখাশোনা করি। বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করব।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল  বলেন, ‘উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন বারে যেসব আইনজীবী প্র্যাকটিস করেন তার মাত্র পাঁচ ভাগ সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং সরকারি বেতনভুক্ত। বাকিদের আয়-রোজগার আদালতে প্রতিদিনের মামলার ওপর নির্ভরশীল। করোনার কারণে ৪০ হাজার আইনজীবীর পেশা ও জীবন-জীবিকা বন্ধ। আমার জানা মতে, বহু আইনজীবী ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকেই আর্থিক সহযোগিতার জন্য আমাদের কাছে আসছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইনজীবীদের বিচারাঙ্গনের অপরিহার্য অংশ বলা হলেও বাস্তবে তার প্রমাণ দেখি না। তাদের পাশে যাদের দাঁড়ানোর কথা সেই বার কাউন্সিল সময়মতো অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষা নিতে যেমন ব্যর্থ তেমনি আইনজীবীদের পাশে দাঁড়াতেও তারা নির্লিপ্ত। সুপ্রিম কোর্ট বার কোনো সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান না হলেও গত বছর আইনজীবীদের জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বার কাউন্সিল সরকারের আইন দ্বারা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখন তারা কেন সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নিয়ে আইনজীবীদের পাশে দাঁড়াবে না!’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আদালত খোলা না থাকলে আইনজীবীদের কোনো আয়-রোজগার নেই। এ পরিস্থিতিতে তাদের যে কী সমস্যা হচ্ছে, কী অসহায় অবস্থায় তারা দিন পার করছেন সেটি আমি জানি। সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত ফোন আসে। অনেকেই খুব দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন। কেউ কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না। আইনজীবীরা তো কারও কাছে কিছু চান না। এখন এই দুর্যোগময় সময়ে তাদের জন্য কী করা যায় সে বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইনজীবীদের জন্য করোনারোধী টিকার ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করা হয়েছে। তাদের সবাইকে যদি টিকার আওতায় আনতে পারি তাহলে হয় তো আদালত খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আর সিনিয়র আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান থাকবে যাদের একটু সক্ষমতা আছে তারা যেন জুনিয়র ও তরুণ আইনজীবীদের পাশে দাঁড়ান।’