ঢাকা শুক্রবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৫, ৫ই বৈশাখ ১৪৩২


শুল্কযুদ্ধে তছনছ বিশ্ববাণিজ্য


৯ এপ্রিল ২০২৫ ১১:৪৩

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৫ ০১:০৩

পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের জেরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের আরোপিত ৩৪ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যেও একই পরিমাণ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দিয়েছে চীন। এর জের ধরে চীনা পণ্যের ওপর আরো ৫০ শতাংশ শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গতকাল মঙ্গলবার হোয়াাইট হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, চীনের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১০৪ শতাংশ করা হচ্ছে।

বুধবার থেকে এটি কার্যকর হবে।

গত সোমবার নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ‘মঙ্গলবারের মধ্যে চীন যদি পাল্টা ৩৪ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার না করে তবে অতিরিক্ত আরো ৫০ শতাংশ শুল্ক বাসানো হবে। বুধবার থেকেই বাড়তি এ শুল্ক কার্যকর হবে।’ এ ছাড়া চীনের অনুরোধে আলোচনায় বসার সম্ভাবনাও বাতিল করা হবে বলে জানান ট্রাম্প।

গতকাল আরেকটি পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ‘চুক্তি করতে মুখিয়ে আছে চীন। তবে তারা জানে না কিভাবে এর সূচনা করতে হবে। আমরা চীনের কাছ থেকে ফোন পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। চুক্তি হবে।’

এর আগে গত মার্চে চীনের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এতে সব মিলিয়ে চীনের তৈরি পণ্যের ওপর ১০৪ শতাংশ শুল্ক বসতে যাচ্ছে।

এদিকে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘ব্ল্যাকমেইলিং আচরণ’ কখনোই মেনে নেবে না বলেও জানিয়েছে দেশটি।

চীনা পণ্যের ওপর আরো ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিকে ‘ভুলের ওপর ভুল’ বলেও আখ্যা দিয়েছে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

চীনের অবস্থান হলো, শুল্কারোপের এই পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হোক। আর দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার মতপার্থক্যের সমাধান করা হোক।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ আরো তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাণিজ্যবিশ্লেষকরা।

এদিকে গত সোমবার হোয়াইট হাউসে দেওয়া এক বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, সমম্প্রতি তিনি যে নতুন শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তা স্থগিত করার ব্যাপারে তিনি ভাবছেন না। এমনকি এ নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে দর-কষাকষি করতেও আপাতত ইচ্ছুক নন তিনি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ৯০ দিনের জন্য নতুন আরোপিত শুল্ক স্থগিত করতে পারে বলে আভাস পাওয়া যায়। এই দাবিকে ‘ভুয়া খবর’ বলেছে হোয়াইট হাউস। শুল্ক স্থগিতের সম্ভাবনার ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা সেটার কথা ভাবছি না। অনেক দেশ আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে আসছে, আর এগুলো হবে ন্যায্য চুক্তি।’

২ এপ্রিল ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই দিনটিকে তিনি ‘মুক্তির দিন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর আরোপিত ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্কের অংশ হিসেবেই চীনের ওপরও তখন ওই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এর আগে গত মার্চেও চীনা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি আবারও চীনের ওপর এই ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তাহলে চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত এই মোট ১০৪ শতাংশ শুল্ক চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানি করা মার্কিন কম্পানিগুলোর জন্য এক বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

এ ব্যাপারে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি আগেই সতর্ক করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি কোনো দেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তবে তারা সঙ্গে সঙ্গে নতুন ও অনেক বেশি হারে শুল্কের মুখোমুখি হবে।’

এর প্রতিক্রিয়ায় চীন বলেছে, ‘চীনকে চাপ বা হুমকি দিয়ে কখনোই লাভ হবে না।’ ওয়াশিংটনে অবস্থিত চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইউ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পারস্পরিক সুবিধাদানের নীতির নামে’ একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা মূলত অন্য দেশের ন্যায়সংগত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে চলার নামান্তর। তিনি আরো বলেন, এটা এক ধরনের একতরফাবাদ, সংরক্ষণবাদ ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন।

অবশ্য কিছু শুল্ক স্থায়ী হতে পারে, আবার কিছু কিছু নিয়ে আলোচনা সম্ভব উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন, আমাদের ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ‘ন্যায্য ও ভালো মানের চুক্তি’ করার ব্যাপারে আলোচনা করবে। তিনি আরো বলেন, এখন সময় আমেরিকা ফার্স্টের। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখার।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমে বাড়তে থাকা এই উত্তেজনা বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কাকে আরো জোরালো করেছে। পণ্যে রপ্তানিতে চীনের অন্যতম প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র হওয়ায় এই অতিরিক্ত শুল্ক চীনের উৎপাদকদের জন্য একটি বড় আঘাত।

অন্যদিকে শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। নতুন শুল্ক ঘোষণার পর থেকেই বিশ্বের প্রায় সব বড় শেয়ারবাজার দরপতনের মুখে পড়েছে। এশিয়ার বাজারগুলো আরো বড় ধাক্কা খেয়েছে। হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচক এক দিনেই ১৩ শতাংশ পড়ে গেছে। ১৯৯৭ সালের পর এটি সবচেয়ে বড় পতন।

এদিকে ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্কারোপের প্রতিক্রিয়ায় এবার পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইউরোপের ২৭টি দেশের এই জোট মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। গত সোমবার লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে ইইউ নেতারা এই প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামী ১৬ মে থেকে মার্কিন পণ্যের ওপর ইইউয়ের এই নতুন শুল্কনীতি কার্যকর হতে পারে।

সূত্র : বিবিসি, এএফপি, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স