ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৫, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩২


দেশীয় প্রযুক্তিতে রেলের টার্ন টেবিল, আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেন তাসরুজ্জামান


২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৪৪

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:১৩

দেশীয় প্রযুক্তিতে রেলের ইঞ্জিন ও কোচ ঘোরানোর টার্ন টেবিল তৈরিসহ বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলী মো. তাসরুজ্জামান বাবু। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টেভি অ্যাওয়ার্ড ইনকরপোরেশনের এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ঘোষিত পুরস্কারের ‘মোস্ট ইনোভেটিভ টেকনোলজি লিডার অব দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরিতে ‘সিলভার স্টেভি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ পেয়েছেন তিনি।

তাসরুজ্জামান বাবু রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) হিসেবে কর্মরত। গত ১৬ এপ্রিল স্টেভি অ্যাওয়ার্ড ইনকরপোরেশনের ওয়েবসাইটে অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করা হয়। একই ক্যাটাগরিতে সহ–বিজয়ী হিসেবে গুগল, অ্যামাজনসহ আরও কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবকেরা আছেন। আগামী ১৩ মে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদকটি তুলে দেওয়া হবে।

বিশ্বের অন্যতম ব্যবসায়িক পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা ‘স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস’। এবার তারা দ্বাদশ বার্ষিক এশিয়া-প্যাসিফিক স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস ঘোষণা করল এই পুরস্কারের মাধ্যমে তারা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে কর্মক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেয়।

বিভিন্ন বিভাগে গোল্ড, সিলভার এবং ব্রোঞ্জ স্টেভি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের নাম গত ২ এপ্রিল ঘোষণা করা হয়। সেটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় ১৬ এপ্রিল। বিশ্বজুড়ে ১২০ জনেরও বেশি বিচারকের গড় স্কোরের ভিত্তিতে এই পুরস্কারগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে।

লালমনিরহাটে স্থাপিত দেশের প্রথম টার্ন টেবিল। ছবি: সংগৃহীত
২০২৫ সালের এশিয়া-প্যাসিফিক স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, মূল ভূখণ্ড চীন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ম্যাকাও, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিলিপাইন, পুয়ের্তো রিকো, সাও টোমে অ্যান্ড প্রিন্সিপে, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনামসহ ২৩টি বাজারের সংস্থাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তাসরুজ্জামানের মূল উদ্ভাবন: দেশীয় প্রযুক্তিতে রেলের টার্ন টেবিল

* তাসরুজ্জামান বাবুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হলো রেলের ইঞ্জিন ও কোচ ঘোরানোর জন্য টার্ন টেবিল তৈরি করা। এর আগে বাংলাদেশে ব্যবহৃত টার্ন টেবিলগুলো ব্রিটিশ আমলে স্থাপন করা হয়েছিল এবং সেগুলো বিদেশ থেকে আনা হতো।

* তাঁর তৈরি টার্ন টেবিলটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত প্রথম টার্ন টেবিল। এটি লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে।

* এই স্বয়ংক্রিয় টার্ন টেবিলটিকে স্টেভি অ্যাওয়ার্ডের জুরি বোর্ড দক্ষিণ এশিয়ার ‘প্রথম অটোমেটেড টার্ন টেবিল’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

টার্ন টেবিলের গুরুত্ব কী

* একটি রেলের কোচ বা ইঞ্জিনকে নির্দিষ্ট সময় পর টার্ন টেবিলের ওপর ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে বগির চাকার দুই পাশ সমানভাবে ক্ষয় হয় এবং চাকার স্থায়িত্ব বাড়ে।

* ইঞ্জিনের চালক যদি পেছনের দিকে মুখ করে বসেন, তবে রেললাইনের সংকেত দেখতে অসুবিধা হয় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। টার্ন টেবিলের মাধ্যমে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে চালকের সুবিধা মতো দিক নির্ধারণ করা যায়।

* লালমনিরহাটে টার্ন টেবিল না থাকায় মিটারগেজের ইঞ্জিন ও কোচগুলোকে ঘোরানোর জন্য কয়েক মাস পর পর ঢাকার কমলাপুরে নিয়ে যেতে হতো, যা ছিল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া, যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে কোচবিহীন হালকা ইঞ্জিন পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অতিরিক্ত কোচ সংযোগের প্রয়োজন হতো। তাসরুজ্জামানের উদ্ভাবিত টার্ন টেবিল এই সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে।

তাসরুজ্জামানের অন্যান্য উদ্ভাবন

২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লালমনিরহাট রেলওয়েতে কর্মরত থাকাকালীন তাসরুজ্জামান বাবু আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

* ভাঙন প্রতিরোধী দীর্ঘস্থায়ী হুইল সেট গাইড: এটি রেলের চাকার স্থায়িত্ব বাড়াতে সাহায্য করে।

* রেল দুর্ঘটনায় কোচ ও লোকোমোটিভ উদ্ধার কাজে ব্যবহার্য রি-রেইলিং ইকুইপমেন্টস: এটি দুর্ঘটনা কবলিত বগি ও ইঞ্জিন দ্রুত উদ্ধারে সহায়ক।

* কোচের শিডিউল ঠিক করার জন্য প্রথম ইলেকট্রিক লিফটিং জ্যাক: এটি কোচ মেরামতের কাজকে আরও সহজ ও দ্রুত করেছে।

তাসরুজ্জামানের শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন

* তাসরুজ্জামান বাবু ৩৫ তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।

* তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

* এ ছাড়া তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বৃত্তি নিয়ে জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (গ্রিপ্স) থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন।