“বাংলাদেশে উন্নত বায়ুমান বছরে বাঁচাতে পারে ৮০ হাজারের বেশি জীবন, রক্ষা হবে বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি”

বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) এর যৌথ আয়োজনে ১৮ জানুয়ারী ২০২৫ শনিবার সকালে মানিক মিয়া হল, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকায় "Clean Air for Healthy Lives: Urgency of Addressing Air Quality" শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন ও রিপোর্ট লঞ্চিং অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত সংবাদ সম্মেলন ও রিপোর্ট লঞ্চিং প্রগ্রামে এ “বাংলাদেশে সূক্ষ্মকণা বায়ু দূষণে জনস্বাস্থ্য প্রভাব” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি উক্ত প্রোগ্রাম এ ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রধান শহরগুলোতে বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়। যা কার্যকর রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। পাশাপাশি, একটি ইন্টারেক্টিভ ড্যাশবোর্ড চালু করা হয়, যা সকল অংশীজনদের শহর ও জেলার ভিত্তিতে রিয়েল-টাইম দূষণের তথ্য এবং এর সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ প্রদান করে। যাতে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার এর সঞ্চালনায় উক্ত সংবাদ সম্মেলন ও রিপোর্ট লঞ্চিং অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব প্ল্যানারস এর সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মাদ খান, গেস্ট অফ অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব তপন কুমার বিশ্বাস, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সুইডেন দূতাবাস বাংলাদেশ এর ফার্স্ট সেক্রেটারি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডেপুটি হেড, ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন সেকশন এর নাইওকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রোম। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের রেসিপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল ইসলাম, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাক্তার আয়েশা আক্তার এবং সেন্টার ফর ল' এন্ড পলিসি এফেয়ার্স (সিএলপিএ) এর সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন। মূল প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিআরইএ-এর বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি। সিআরইএ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান জুম প্ল্যাটফর্মে যোগদান করেন।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন প্রদান করেন সিআরইএ এর বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি, তিনি তার বক্তব্যে বলেন, সিআরইসিএ-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, PM2.5 প্রতি বছর দেশে প্রায় ১,০২,৪৫৬ মৃত্যুর জন্য দায়ী, যা ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, নিম্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত। পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকে, যাদের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৫,২৫৮ জনের মৃত্যু PM2.5 সম্পর্কিত নিম্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে ঘটে। বাংলাদেশের বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। এই পরিস্থিতি এমন হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা সবচেয়ে অরক্ষিতদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। PM2.5 দূষণ প্রতি বছর প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি সৃষ্টি করে, যা উৎপাদনশীলতার বড় ধরনের ক্ষতি করে ব্যবসা ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশের বায়ু দূষণ সমস্যার সমাধান জনস্বাস্থ্য এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সমতুল্য,"
সিআরইএ এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান বলেছেন, "সিআরইএ-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিভিন্ন বায়ু মানের মানদণ্ড, বাংলাদেশের বর্তমান মান এবং ২০০৫ ও ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা তুলনা করে দেখা গেছে যে, পিএম ২.৫ স্তরে সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধা এনে দিতে পারে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি গ্রহণের মাধ্যমে বায়ু দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব"।
ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি শুধু মানবদেহকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই, এ মুহূর্ত থেকেই দূষণ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ এবং নীতিমালা গ্রহণ করা না হলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বায়ুদূষণের কারণে গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে।
সুইডিশ দূতাবাস বাংলাদেশ-এর ফার্স্ট সেক্রেটারি (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন) মিসেস নায়োকা মার্টিনেজ –ব্যাকস্ট্রম বলেন, বায়ুদূষণ ঢাকা এবং বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিষ্কার উৎপাদন ব্যবস্থা, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা ও প্রণোদনা তৈরি, কার্যকর গণপরিবহন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ। সুইডিশ সরকার অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের সাথে মিলে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন- সামাজিক নিরাপত্তা জাল, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণসহ নানাক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে সহায়তা প্রদান করছে এবং বাংলাদেশে গুরুতর বায়ুদূষণ হ্রাসে আরও সহযোগিতার আশা করছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ) তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, পিএম২.৫ বাংলাদশে নি:সন্দেহ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বায়ু দূষণ কমাতে সরকার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন দর্শনে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ জন্য আইন সংস্কারসহ এর কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
সেন্টার ফর ল এন্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, পরিবেশ আদালত আইন সংশোধনের মাধ্যমে বায়ু দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব এবং এতে জনগণের সরাসরি মতামত প্রকাশ করার অধিকার দিতে হবে যা সার্বিকভাবে দূষণ কমিয়া আনতে সহযোগিতা করবে।
২৫০ শয্যা টিভি হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বায়ু দূষণের কারণে শিশু মহিলা গর্ভবতীর বয়স্করা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। দূষণ কমাতে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বায়ু দূষণ স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে বাইরে সব সময় মাস্ক ব্যবহার করা উচিত, এবং যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার কমাতে হবে এবং টেকসই পরিবহন মাধ্যম যেমন সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য আরও বেশি হাঁটার পথ এবং সাইকেলের জন্য নির্দিষ্ট লেন তৈরি করতে হবে, যা এই পরিবর্তনকে উৎসাহিত করবে।
এছাড়াও উক্ত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মী, সামাজিক ও পরিবেশবাদি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলন ও রিপোর্ট লঞ্চিং অনুষ্ঠানে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়:
· বাংলাদেশকে নিজস্ব জাতীয় নির্দেশিকা মেনে চলার পাশাপাশি তা প্রয়োগ করতে হবে। মাঝারি মেয়াদে ২০০৫ সালে ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম এর দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসাবে ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা উচিত.
· কয়লা ও ডিজেলের মত কার্বণ নিঃসরণকারী জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়া ক্লিন পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদে পিএম২.৫ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
· শিল্পখাতে নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ: কঠোর শিল্প নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যানবাহন এবং কলকারখানার নির্গমন মান বাড়াতে হবে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে ধাপে ধাপে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ফলাফল নিশ্চিতের জন্য অধীক দুষণকারী শিল্প যেমন ইট ভাটা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।
· মনিটরিং নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ: ভূমিভিত্তিক এবং স্যাটেলাইট ডেটা একত্রিত করে জাতীয় পর্যবেক্ষণ কাঠামো তৈরি করতে হবে, যা পিএম২.৫ -এর প্রবণতা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণে সহায়ক হবে।