ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


ডাকাতদলের নেতৃত্বে দুই এসআই!


৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:২১

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০১:১৯

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপপরিদর্শক (এসআই) আকসাদুজ্জামান। কর্মরত ছিলেন সংস্থাটির ডেমরা জোনে। দীর্ঘদিন ধরেই আছেন সিআইডিতে। পুলিশ বাহিনীতে চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়েন আকসাদুজ্জামান। এমনকি ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন ডাকাতদলের সঙ্গে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তার নেতৃত্বে ঘটেছে একাধিক অপরাধের ঘটনা।

২০২০ সালে রাজধানীর শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় এক প্রবাসীর টাকা লুটের অভিযোগ ওঠে আকসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আসার পর তদন্তে নামে পুলিশের একটি সংস্থা। তাছাড়া ওই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। আসামিদের জবানবন্দিতেও আকসাদুজ্জামানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর থেকে ছিলেন লাপাত্তা। তবে শেষমেশ তাকে দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা থেকে গতকাল বুধবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে।

আকসাদুজ্জামানে মতোই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক এসআইও একই ধরনের কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তার নাম রাশেদ। তিনি দীর্ঘদিন ডিবির গুলশান ডিভিশনের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের সদস্য ছিলেন। ২০১৯ সালে গুলশান এলাকায় এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর অর্ধকোটি টাকা লুট করে রাশেদের নেতৃত্বে একটি চক্র। এ ঘটনায় ওই হুন্ডি ব্যবসায়ী গুলশান থানায় মামলা করেন। তখন প্রথমে বরখাস্ত করা হয় রাশেদকে। একপর্যায়ে গ্রেপ্তারও করা হয় তাকে। প্রায় ছয় মাস কারাভোগের পর বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আকসাদুজ্জামান ও রাশেদ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে বেশি বেপরোয়া আকসাদুজ্জামান। তার চক্রে রয়েছেন সিআইডির একজন কথিত রাইটার ও সাবেক এক সেনাসদস্য। এই চক্রের টার্গেটে থাকত বিদেশগামী ও বিদেশফেরত প্রবাসীরা। ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সিআইডিতে ভাড়ায় চালিত একটি মাইক্রোবাস। গত বছর বিমানবন্দর যাওয়ার পথে এক প্রবাসীর টাকা ও মালামাল লুটের মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এমন সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাশেদ জামিনে কারামুক্ত হয়ে আকসাদুজ্জামানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে এসআই আকসাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

আকসাদুজ্জামানের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা জোনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০২০ সালের শেষের দিকে বিমানবন্দর এলাকায় এক প্রবাসীর টাকা-পয়সা লুট হয়। থানায় মামলা হলে তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ। একপর্যায়ে ওই মামলায় ৬ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে হাসান রাজা নামে এক আসামির জবানবন্দিতে সিআইডির এক এসআইর নাম উঠে আসে। এমন তথ্য আসার পর তার বিষয়ে আরও বিস্তারিত তদন্ত করে ঘটনার মূল হোতা হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়। এরপর সিআইডিকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর পর সম্প্রতি তারা এসআই আকসাদুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে। তারপর থেকে তিনি পলাতক। তাকে গ্রেপ্তার করতে ডিবির অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দু-একদিনের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’

এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ডিবির এসআই রাশেদও একই ধরনের কর্মকা- চালিয়েছে। ২০১৯ সালে টাকা লুটের ঘটনায় রাশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিনে বের হয়ে তিনি আকসাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাকেও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।’

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১৯ অক্টোবর দুবাই যাওয়ার জন্য টিকাটুলীর বাসা থেকে থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বিমানবন্দরের পথে রওনা হন রোমান মিয়া নামে এক প্রবাসী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফুপাতো ভাই মনির হোসেন। তাদের অটোরিকশাটি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিমানবন্দরসংলগ্ন কাওলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে পৌঁছালে একটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেল এসে গতিরোধ করে। পরে ডিবি সদস্য পরিচয়ে রোমান মিয়াকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। আর মনির হোসেনকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। পরে রোমানকে গাড়ির ভেতর মারধর করে আনুমানিক ৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা সমমূল্যের ইউএস ডলার, দিরহাম ও মোবাইল ফোন লুটে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে রামপুরা স্টাফ কোয়ার্টার রোডে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরে দুই নারী রোমানকে উদ্ধার করে তার আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তারা রোমানকে বাসায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পরদিন ২০ অক্টোবর রোমান মিয়া বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। থানায় করা মামলা তদন্তের একপর্যায়ে কাওলা এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। সেই ফুটেজে দেখা যায়, সকাল ৭টা ৩৪ মিনিটে রোমান মিয়াকে বহনকারী অটোরিকশাটিকে একটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেল অনুসরণ করছে। অভিযোগ নিশ্চিত হওয়ার পর বাদীকে ডেকে পাঠানো হয় ডিবি কার্যালয়ে। তিনি গাড়িটি শনাক্ত করেন। পরে ওই গাড়ির নাম্বার প্লেটের সূত্র ধরে গাড়িটির মালিককে ডেকে আনে পুলিশ। তিনি পুলিশকে জানান, গাড়িটি সিআইডিতে বাৎসরিক চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। চালককে ডেকে পাঠালে তিনি ওইদিন ভোরে সিআইডির এক এসআইকে বিমানবন্দর এলাকায় নিয়ে যান বলে স্বীকার করেন। একই সঙ্গে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। এরপর এসআই আকসাদুজ্জামান সম্পর্কে ধারণা পায় পুলিশ। কিন্তু তখন পর্যন্ত তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা তা নিশ্চিত হতে কিছুটা বেগ পেতে হয় পুলিশকে। পরে পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ঢাকার রামপুরা ও কাফরুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আমির হোসেন তালুকদার, রিজু মিয়া, হাসান রাজা, মোশারফ হোসেন, সেলিম মোল্লা ও মো. রিপন মোড়লকে। তাদের মধ্যে হাসান রাজা ও সেলিম মোল্লার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও মাদারীপুরে ৩টি করে ডাকাতি মামলা রয়েছে। আসামিদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সাবেক সেনাসদস্য হাসান রাজা। সেখানে তিনি দাবি করেন, এই চক্রের মূল হোতা সিআইডির এসআই আকসাদুজ্জামান। তার পরিকল্পনায় এ ঘটনা ঘটেছে। এরপর নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দারা। তারা একপর্যায়ে আকসাদুজ্জামানের কলরেকর্ড পরীক্ষা করে হাসান রাজার ভাষ্যের সত্যতা পান। কলরেকর্ডে দেখা যায়, কয়েকজন সোর্সের সঙ্গে কথা বলছেন আকসাদুজ্জামান। তার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত সিআইডির কথিত রাইটার মোশারফের ভয়েজ রেকর্ড পাওয়া যায়। সেখানে বলতে শোনা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রবাসীদের কাছ থেকে মালামাল লুট করার পরিকল্পনা। এর আগেও তারা এ ধরনের আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে বলে রেকর্ডে পরিষ্কারভাবে শুনতে পান তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তাছাড়া টাকা লুটের ঘটনায় আকসাদুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও পুলিশের হাতে একাধিক প্রমাণ আসে। ঘটনার বিস্তারিত জানতে তাকে তিন দফা ডিবি কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এতে ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকারও করেন তিনি। এরপর সিআইডির একজন সহকারী পুলিশ সুপারের জিম্মায় তাকে ফেরত পাঠানো হয়। পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সম্প্রতি বরখাস্ত করা হয় এসআই আকসাদুজ্জামানকে। তারপর থেকে তিনি লাপাত্তা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার কায়সার রিজভী কোরাইশী বলেন, ‘গ্রেপ্তার ছয়জনের মধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে ডাকাতি চক্রের মূল হোতা হিসেবে এসআই আকসাদুজ্জামানের নাম উঠে এসেছে। ঘটনার দুদিন আগে আকসাদুজ্জামান তার সোর্সের মাধ্যমে ডলার নিয়ে বিদেশগামী যাত্রীর বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এরপর সে সঙ্গীদের জোগাড় করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিআইডির কথিত রাইটার মোশারফসহ তারা খিলগাঁও এলাকায় জড়ো হয়। এরপর তারা সিআইডিতে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিআইডিতে ব্যবহৃত (ঢাকা মেট্রো-চ-১৯-২২৩৭) নাম্বারের মাইক্রোবাস চালক হারুন-অর-রশিদকে ফোন দেয় আকসাদুজ্জামান।’

এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অভিযানের কথা বলে তাকে (চালক) ভোরে আসতে বলা হয়। ঘটনার দিন আকসাদুজ্জামানের সিআইডির ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। এ কারণে হারুন গাড়ি নিয়ে সিআইডির সামনে এলে তাকে খিলগাঁও এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আরও ৬-৭ জন গাড়িতে ওঠে। এরপর তাদের অনুসরণ করতে থাকে আরও ২টি মোটরসাইকেল। তারা কাওলা এলাকায় সিএনজি অটোরিকশাটি ব্যারিকেড দিয়ে একজনকে তুলে নেয়। এরপর ওই যাত্রীর কাছ থেকে মালামাল লুটে রামপুরার স্টাফ কোয়ার্টার রোডে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সিএনজি অটোরিকশাচালক, রোমান মিয়াকে উদ্ধারকারী নারী, তার ভাই, সিআইডির ভাড়ায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাস চালক ও এক আসামি জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে এসআই আকসাদুজ্জামানের নাম বলেছেন তারা।’

ডিবির গুলশান জোনের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘২০১৯ সালে গুলশান এলাকায় এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর টাকা লুটের ঘটনায় ডিবির এসআই রাশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। রাশেদ নানা অপকর্মে জড়িত ছিল বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। পুলিশের চাকরি করে কাউকে অপরাধ করতে দেওয়া হবে না। যারা অপরাধ করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কারও ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসআই রাশেদ এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর ৫০ লাখ টাকা লুট করে। এ ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা হয়। ওই ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর আমরা তদন্ত করে নিশ্চিত হওয়ার পর রাশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাশেদ লুট করা টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। প্রায় ৬ মাসের মতো সে কারাগারে আটক ছিল। পরে সে জামিনে বের হয়ে আসে।’

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রাশেদ জামিনে এসে বরখাস্ত হওয়া সিআইডির এসআই আকসাদুজ্জামানের সঙ্গে আঁতাত করে আসছিল। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তারা একই সিন্ডিকেটের সদস্য বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাকেও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তাছাড়া লাপাত্তা হওয়া আকসাদুজ্জামানকে উত্তরবঙ্গের একটি জেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিবির কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আজ তাকে আদালতে পাঠানো হবে।’