কাঠগড়ায় রোহিঙ্গা নির্যাতন

নেদারল্যান্ডসের হেগের পিস প্যালেসে আজ শুরু হচ্ছে রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি। দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবু বাকার তামবাদু এ মামলার নেতৃত্ব দেবেন। অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষে লড়তে হেগেতে উপস্থিত হয়েছেন একসময়ের বিশ্ব শান্তিকন্যা দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি।
বিশ্ব গণমাধ্যম এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের দাবি, রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুতে আইসিজেতে গাম্বিয়ার পক্ষে জোরালো সমর্থন বাড়ছে। এ ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে প্রকাশ্যে নেই কেউ। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, আইসিজেতে আবু বাকার তামবাদুরের তথ্য-প্রমাণ আর যুক্তির বিপরীতে কী জবাব দেবেন সু চি তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে।
ইতিমধ্যে নেদারল্যান্ডস ও কানাডা গাম্বিয়ার পক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটি থেকে পালিয়ে আসা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার সাময়িক আশ্রয় দেওয়া ভুক্তভোগী দেশ বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল তথ্য-উপাত্তসহ হাজির হচ্ছে পিস প্যালেসে। গাম্বিয়াকে তথ্য-প্রমাণ সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশ এ শুনানি পর্যবেক্ষণ করবে।
এদিকে পিস প্যালেসের সামনে সু চি ও মিয়ানমারবিরোধী বিক্ষোভে প্রস্তুত বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার প্রতিনিধি এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। রোহিঙ্গাদের একাধিক প্রবাসী গোষ্ঠী হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মামলার শুনানি চলাকালে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছে। মিয়ানমার সরকারের সমর্থনেও সেখানে সমাবেশের পরিকল্পনা করছেন দেশটির নাগরিকরা।
সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বৈশ্বিকভাবে মিয়ানমারকে বয়কটের ডাক দিয়ে এক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্বের ১০ দেশের ৩০টি মানবাধিকার সংস্থা। রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি শুরুর এক দিন আগে গতকাল সোমবার
বৈশ্বিক এ বয়কটের ডাক দিয়ে ‘বয়কট মিয়ানমার ডট অর্গ’ চালু করেছে তাদের ‘বয়কট মিয়ানমার ক্যাম্পেইন’। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন, ফরসি ডট কো, রেস্টলেস বিংস, ডেস্টিনেশন জাস্টিস, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক অব কানাডা, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ অব ইন্ডিয়া ও এশিয়া সেন্টার। এ নিয়ে বয়কট রোহিঙ্গা ডট অর্গ লন্ডন থেকে তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসে এসব সংগঠন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমারকে বর্জনের আহ্বান সংবলিত প্রচার শুরু করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নৃশংসতা, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পক্ষে প্রত্যক্ষ ও ডকুমেন্টারি প্রমাণ রয়েছে। সারা বিশ্ব এর নিন্দা জানালেও হতাশার কথা, এ অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি।
জার্মানভিত্তিক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাই সান লুইন বলেছেন, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিকে নির্মূল করে দেওয়ার একটি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী হিসেবে আমরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অধীনে ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকা অং সান সু চির মুক্তির আন্দোলন করে এসেছি। কিন্তু তিনি সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শুধু খুনি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে চলছেন। তাই আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানাই।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে, মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি দেখেছেন, একইভাবে রাষ্ট্র নির্দেশিত সেনাবাহিনী তার জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একই রকম নির্যাতনে লিপ্ত। এসব সংখ্যালঘুর মধ্যে রয়েছে শান, কাচিন, তা’আং, কারেন, রাখাইন এবং চিন সম্প্রদায়।
আইসিজের ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গাম্বিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেবেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবু বাকার মারি তামবাদু। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তামবাদুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডসসহ বেশ কয়েকজন বিশ্ব পরিসরে নেতৃস্থানীয় আইনজ্ঞ শুনানিতে অংশ নেবেন।
আজ আদালতে গাম্বিয়া তার বক্তব্য উপস্থাপন করবে এবং বুধবার মিয়ানমার তার অবস্থান তুলে ধরবে। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে গাম্বিয়া এবং বিকেলে মিয়ানমার প্রতিপক্ষের যুক্তি খ-ন ও চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করবে।
এর আগে আদালতে গত ১১ নভেম্বর পেশ করা আবেদনে গাম্বিয়া বলেছে, কথিত সাফাই অভিযানের সময় গণহত্যামূলক কর্মকা- সংঘটিত হয়েছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল গোষ্ঠীগতভাবে অথবা আংশিকভাবে রোহিঙ্গা জাতিকে নির্মূল করা। এজন্য গণহারে হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা, কখনো কখনো বাড়িতে লোকজনকে আটকে রেখে জ¦ালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামগুলোকে ধ্বংস করেছে।
গাম্বিয়া গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ৩ নম্বর ধারার আলোকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশই ১৯৪৮ সালে গৃহীত এই সনদে স্বাক্ষরকারী এবং ওই ধারায় সনদ লঙ্ঘনবিষয়ক বিরোধ আইজিসেতে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। গাম্বিয়া ১১ অক্টোবর মিয়ানমারকে সনদ লঙ্ঘনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি নিরসনে চিঠি দেয়। আদালতে পেশ করা আবেদনে গাম্বিয়া বলেছে, ওই চিঠির কোনো জবাব না পাওয়ায় সংক্ষুব্ধ হয়ে তারা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে।
সনদ লঙ্ঘনের বিষয়ে দেশটি জাতিসংঘের অনুসন্ধানকারী দলের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যগুলোর কথা উল্লেখ করেছে। আবেদনে বলা হয়েছে, গণহত্যামূলক কার্যকলাপ এখনো চলছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গণহত্যার হুমকির মুখে রয়েছে। গাম্বিয়ার দাবি, আইসিজের বিধিমালা এবং গণহত্যা সনদের বিধি অনুযায়ী মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তির এখতিয়ার আদালতের রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে করা মামলার শুনানিতে অংশ নিতে হেগের উদ্দেশে গতকাল রওনা হয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এ শুনানিতে অংশ নিতে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকেরও যাওয়ার কথা রয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী দুই দশকের বেশি সময় ধরে অন্তরীণ করে রেখেছিল অং সান সু চিকে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে পরিচিত সু চি এখন ওই জনগোষ্ঠীরই নেতা, যাদের গণতন্ত্র দিতে সর্বত্র বাধা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। এখন ওই সেনাবাহিনীকেই রক্ষা করার জন্য শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন সু চি। তিনি আরও বলেন, তবে সু চির সামরিক বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে সখ্য অব্যাহত রাখা কোনোটাই অপ্রত্যাশিত নয়।
সু চির সামনে নির্বাচন আছে এবং আগেরবার তিনি ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে। এখন সু চি সরকারের অংশ এবং সেনাবাহিনীও সরকারের অংশ। তবে তিনি গণতন্ত্রের জন্য যখন সংগ্রাম করছিলেন এবং বাকি পৃথিবীর সমর্থন পাচ্ছিলেন তখন বিষয়টি ছিল একরকম। এখন সেনাবাহিনী এবং সু চি একইপক্ষ, কারণ তারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করছেন।