ঢাকা বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১


বাজারে সব ধরণের রেনিটিডিন নিষিদ্ধ


১৫ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৩৪

আপডেট:
৮ মে ২০২৪ ০২:৪৪

সাময়িক নিষেধাজ্ঞার পর এবার দেশে রেনিটিডিন জাতীয় সব ধরনের ওষুধ স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করল সরকার। শুধু ভারতের দুই কোম্পানিই নয়; এখন থেকে কোনো দেশের কাঁচামাল দিয়েই আর বাংলাদেশে রেনিটিডিন উৎপাদন, বিক্রি, বিতরণ ও রপ্তানি করতে পারবে না দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো।

ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচামালে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশিমাত্রায় শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন-নিট্রোসডিমিথাইলামাইন (এনডিএমএ) পাওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ নির্দেশ জারি করে। এর ফলে অ্যাসিডিটির জন্য এখন থেকে দেশের মানুষকে পিপিআই (প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর) গোত্রের ওমিপ্রাজল, রেবিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, ল্যানসোপ্রাজল জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ভারতের মেসার্স সারাকা ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড এবং মেসার্স এসএমএস লাইফসায়েন্স থেকে আমদানি করা রেনিটিডিন হাইড্রোক্লোরাইড কাঁচামাল (এপিআই) এবং ওই কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধের নমুনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পরীক্ষাগারে (সিঙ্গাপুর) পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করেছে অধিদপ্তর। পরীক্ষার ফলাফলে পরীক্ষাকৃত কাঁচামাল ও ফিনিশড প্রোডাক্টে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান এন-নিট্রোসডিমিথাইলামাইন (এনডিএমএ) গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এ কারণে জনস্বার্থে দেশে সব ধরনের রেনিটিডিন জাতীয় ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি, বিতরণ ও রপ্তানি স্থগিত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান  বলেন, ভারতের দুই কোম্পানির কাঁচামাল দিয়েই দেশে রেনিটিডিন বানানো হয়। আমরা সব রেনিটিডিন ও কাঁচামালে ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছি। সুতরাং সব কোম্পানির সব ধরনের রেনিটিডিনই নিষিদ্ধ করা হলো। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এসব রেনিটিডিন বাজার থেকে তুলে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা  বলেন, গত ২৯ সেপ্টেম্বর সবার সঙ্গে আলোচনা করে শুধু ভারতের দুই কোম্পানির কাঁচামালে উৎপাদিত রেনিটিডিন অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে আমরা কাঁচামাল ও ওষুধের নমুনা সিঙ্গাপুরে পরীক্ষা করতে পাঠাই। এ সপ্তাহে ওই রিপোর্ট পেয়েছি। তাতে দেখা গেছে, গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের সিংহভাগ রেনিটিডিন বানানো হয় ভারতের এই দুই কোম্পানির কাঁচামাল দিয়ে। মাত্র দুটি কোম্পানি ভারতের আরেকটি কোম্পানি ‘এসএমএস’-এর কাঁচামাল দিয়ে রেনিটিডিন উৎপাদন করছে। কিন্তু বাজারে এই দুই কোম্পানির রেনিটিডিন আলাদা করা সম্ভব নয়। এই অজুহাত নিষিদ্ধ রেনিটিডিনও বাজারে বিক্রি হওয়ার খবর এসেছে। তাই আমরা সব ধরনের রেনিটিডিন নিষিদ্ধ করেছি। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক

ডা. রুহুল আমিন বলেন, আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। তাই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েই সব ধরনের রেনিটিডিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা বলেন, গত ২ অক্টোবর আমরা একটি তালিকা দিয়েছিলাম। তাতে বাজারে পাওয়া যায় এমন ৩২ ধরনের রেনিটিডিন সাময়িকভাবে ও ছয় ধরনের রেনিটিডিন পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উৎপাদন, বিক্রয় ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ৫১ ধরনের রেনিটিডিনের ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এখন সব তালিকার রেনিটিডিন নিষিদ্ধ করা হলো।

অ্যাসিড নিঃসরণ প্রতিরোধসহ পেটের পীড়ার নানা উপসর্গের চিকিৎসায় বিশ্বজুড়ে বহুল প্রচলিত ওষুধ রেনিটিডিনের মধ্যে সম্ভাব্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পাওয়ার পর কয়েকটি দেশ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পর পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে বাংলাদেশও রেনিটিডিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিল।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, যুক্তরাষ্ট্র স্যান্ডোজের তৈরি রেনিটিডিন ক্যাপসুলের মধ্যে ‘এন-নিট্রোসডিমিথাইলামাইন (এনডিএমএ)’ নামে পরিবেশ দূষণজনিত এ উপাদানের উচ্চমাত্রার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর কোম্পানিটি তাদের এই ওষুধ বাজার থেকে তুলে নেওয়ার প্রথম ঘোষণা দেয়। গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন সংস্থা (এফডিএ) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রাথমিক পরীক্ষায় বেশকিছু ব্র্যান্ডের রেনিটিডিনের মধ্যে এনডিএমএ’র উপস্থিতি পাওয়ার পর সতর্কতা জারি করা হয়। তখন এ ওষুধের কোনো ব্র্যান্ডের মধ্যে এনডিএমএ’র ক্ষতিকর মাত্রা নিশ্চিত না হলেও সতর্কতা হিসেবে কানাডা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি কোম্পানি রেনিটিডিন সরবরাহ বন্ধ ও বাজার থেকে তুলে নেয়।

রেনিটিডিন নিষিদ্ধ করার ফলে বাংলাদেশে এ ধরনের ওষুধের কোনো সংকট তৈরি হবে কি না জানতে চাইলে ওষুধ কোম্পানি অপসোনিনের রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের নির্বাহী সাইফুল ইসলাম  বলেন, বাংলাদেশে সব ওষুধ কোম্পানিই ‘এইচ২ ব্লকার’ জাতীয় অ্যাসিডিটির ‘পিপিআই’ ওষুধ উৎপাদন করে। সুতরাং সমস্যা হবে না।

এ জাতীয় প্রচুর ওষুধ বাজারে রয়েছে। সুতরাং রোগীদের অসুবিধা নেই। তবে এখনো সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার কোনো নোটিস ওষুধ কোম্পানিগুলো পায়নি বলে জানান অপসোনিনের এই কর্মকর্তা। তিনি দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, বাজারে আমাদের যে ওষুধগুলো এখন রয়েছে, সেগুলো কী করব, কতদিনের মধ্যে বাজার থেকে তুলতে হবে, সে ধরনের কোনো নির্দেশনা আসেনি। এলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। ভারতের নিষিদ্ধ দুই কোম্পানির বাইরে অন্য একটি কোম্পানির কাঁচামাল দিয়ে অপসোনিন রেনিটিডিন উৎপাদন করে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক লুৎফুল কবির বলেন, রেনিটিডিন নিষিদ্ধ হওয়ায় দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাজারে এর বিকল্প প্রচুর ভালো ওষুধ রয়েছে। রোগীরা রেনিটিডিন যে উদ্দেশ্যে গ্রহণ করছেন, সে জাতীয় ওষুধ আমাদের রয়েছে।

চিকিৎসকরা ঝুঁকি এড়াতে রেনিটিডিন গোত্রের কোনো অ্যাসিডিটির ওষুধ গত সেপ্টেম্বর থেকেই প্রেসক্রাইব করছেন না বলে জানান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া। তিনি বলেন, রেনিটিডিন নিষিদ্ধ হওয়ায় কোনো অসুবিধা নেই। একই গ্রুপের সমান ক্ষমতার তুলনামূলক কম দামের ওষুধ বাজারে রয়েছে। তবে রেনিটিডিন গ্রুপের ওষুধ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগে ওমিপ্রাজল বা ইসোমিপ্রাজলের মতো গ্যাস্ট্রিক আলসারের ওষুধের দাম বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন ফায়দা নিতে না পারেন সেদিকে কঠোর নজর রাখতে হবে।