সাতক্ষীরায় ব্যস্ত সময় পার করছেন নৌকা তৈরির কারিগররা

সারাদিন খটখট শব্দ, হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকা, দড়ি দিয়ে বেঁধে গোন টানা, আলকাতরা টানা, করাত দিয়ে কাঠ কাটা, বিক্রির জন্য নছিমন-করিমনে নৌকা টেনে তুলতে ব্যস্ত তারা। এমনই চিত্র দেখা গেছে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের কোলঘেঁষে পাটকেলঘাটা বলফিল্ড মোড় হতে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত নৌকা পল্লীতে। পাটকেলঘাটায় সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০টির মত কাঠের নৌকা তৈরির কারখানা।
বর্ষা মৌসুমে এখানকার নৌকার চাহিদা বাড়ে। ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে কারখানার কারিগররা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা আসছেন কারখানা থেকে নানা আকারের নৌকা কিনতে। বর্তমানে এসব কারখানায় ট্রলার, কোশা, পালতোলা ও ডিঙ্গি নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। বন্যা ও মৎস্যঘেরে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার ডিঙ্গি নৌকা। মেহগনি, খৈ, চম্বল কাঠ দিয়ে এসব নৌকা তৈরি হয়। প্রতিটি ট্রলার এক মাস, পালতোলা ১০ দিন, বড় নৌকা ৫ দিন, মাঝারি ৩ দিন ও ছোট ডিঙ্গি নৌকা তৈরি করতে ২ দিন সময় লাগে। এতে ২০ সিএফটি থেকে প্রকারভেদে ৪০ সিএফটি কাঠ প্রয়োজন হয়। সর্বনিম্ন ২ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকার মধ্যে ক্রেতারা তাদের পছন্দমতো নৌকা কিনতে পারে।
মেসার্স ঐশী নৌকা কারখানার মালিক শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বাবার ব্যবসার উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও ১৮ বছর ধরে এখানে কাঠের ফার্নিচারের সাথে নৌকা তৈরির কাজ করছি। এ বছর অতিবৃষ্টিতে দীর্ঘস্থায়ী জ্বলাবদ্ধতার কারণে নৌকার চাহিদা তুলনামূলক অনেক বেড়েছে। দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন অনেক জলাবদ্ধ অঞ্চলের মানুষ ও মৎস্যঘের ব্যবসায়ীরা আসছেন নৌকা কিনতে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী নৌকা সরবরাহ করতে আমাদের অনেক সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে। নৌকা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগাড় করতে একটু সময় লাগে।
এদিকে নৌকা কিনতে আসা রমিজুল ইসলাম জানান, এখানকার নৌকা বেশ মজবুত এবং দামও অন্য বাজারের তুলনায় কিছুটা কম থাকায় নৌকা কিনতে আসছি।
করাখানার প্রধান কারিগর হাফিজুর রহমান জানান, তিনি কয়রা থেকে প্রায় ১যুগ আগে অত্র এলাকায় এসে নৌকা তৈরি কাজ শুরু করেন। ১২ হাতের একটি নৌকা তৈরি করতে ৩ হাজার টাকা, ১৪ হাতের একটি নৌকা তৈরি করতে ৪ হাজার টাকা, ১৬ হাতের একটি নৌকা তৈরি করতে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা মজুরী পান বলে জানান।
তিনি আরও বলেন, কারখানার মালিক ১২ হাতের নৌকা ৮ হাজার টাকা বিক্রি করলে ৫০০ টাকা লাভ পায়। ১৪ হাতের নৌকা ১২ হাজার টাকা বিক্রি করলে ১ হাজার টাকা মত, ১৮ হাতের নৌকা ২২ হাজার বিক্রি করলে ২ হাজার ৫ শত টাকা লাভ পায়। বৈশাখ মাস থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত এ ব্যবসা জমজমাট চলে।
পাটকেলঘাটার বাসিন্দা রতন জানান, এখানকার নৌকা তৈরির কারিগররা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং জলবদ্ধতার কারণে নৌকা ও ডিঙির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদের কাজের চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে পাটকেলঘাটা অঞ্চলে নৌকা তৈরির জন্য একটি প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে নৌকা তৈরির কারখানাগুলোতে কারিগররা দিনরাত কাজ করে। এখানে বিভিন্ন আকারের নৌকা, যেমন ডিঙি নৌকা, মাছ ধরার নৌকা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এই নৌকাগুলো শুধু স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে না, বরং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও সরবরাহ করা হয়। বর্ষাকালে নৌকাগুলোর চাহিদা আরও বাড়ে, কারণ তখন রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় নৌকাই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে।
শ্যামনগর থানা থেকে নৌকা ক্রয় করতে আসা স্বপন কুমার জানান, তিনি ১২ হাত লম্বা একটি নৌকা ১৩ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন। তার মৎস্য ঘেরে মাছের খাদ্য দেওয়া ও শ্যাওলা পরিষ্কার করার জন্য এই নৌকা ব্যবহার করা হবে।
যুগীপুকুরিয়া এলাকার বাসিন্দা ও নৌকা তৈরির কারিগর ইমন জানান, ‘তিনজন মিলে একটি নৌকা তৈরিতে দুদিন সময় লাগে। নৌকাপ্রতি মজুরি পায় ৫ হাজার টাকা। মেহগনি, খই, চম্বল ও লম্বু গাছের কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি করি। এসব কাঠ দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকলেও নষ্ট হয় না। এ কারণে এসব কাঠের তৈরি নৌকার চাহিদা বেশি।’
তিনি আরও বলেন, এবার নৌকা বেচাকেনা ভালো হচ্ছে। তবে কাঠ, পেরেক কাটা, পিচ ও আলকাতরার দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় লাভ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারখানার জায়গা ভাড়াসহ সকল খরচ মিটিয়ে সামান্য লাভ হয়।
কারখানার মালিক নূর ইসলাম আরও জানান, কিছুদিন তেমন বেচাকেনা না হলেও বর্তমান নৌকার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে। নৌকা তৈরি করে ডেলিভারি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চারিদিকে ঘের-ভেড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং হঠাৎ বৃষ্টিসহ জলাবদ্ধতার কারণে এ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, এই নৌকাগুলো তালার পাটকেলঘাটা থেকে শুরু করে খুলনা, বাগেরহাট, রূপসা, পাইকগাছা, কয়রা, আমাদী, শ্যামনগর, মুন্সিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মাদারীপুর, শরিয়তপুরসহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে চলে যায়। অধিকাংশ কারিগর আল-আমীন, রেজাউল, মামুনসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় বাড়ি। দৈনিক ৭’শ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরিতে তারা কাজ করছেন।
শিল্পী সৌন্দর্যের কারণে নৌকা পল্লীতে কদর বাড়ায় তৈরি হচ্ছে সুন্দরবনের জেলেদের জন্য সামুদ্রিক নৌকাও। এগুলো আকারে বড়। বর্তমানে কয়েকজন করে কারিগর আলাদা ভাগে ভাগ হয়ে তৈরি করছেন এ ধরনের বেশ কয়েকটি নৌকা।
সামুদ্রিক নৌকা তৈরি কারিগর শেখ হেলাল হোসেন ও সদরুল গাজী জানান, ‘চার বা পাঁচজন মিলে তৈরি করতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে। একটি নৌকা তৈরি করলে ২ লাখ টাকা পাই। সামুদ্রিক নৌকাগুলো মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি করলে সব থেকে মজবুত হবে। সমুদ্রের ঝড়-তুফানের মধ্যে চলাচলের উপযোগী করেই তৈরি করা হয় নৌকাগুলো।’
এ ছাড়াও চিংড়ি ঘেরের জন্য বিখ্যাত সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার ঘের ব্যবসায়ীরা এখানকার নৌকা কেনেন।
বিসিক সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গৌরব দাস বলেন, ‘নৌকা তৈরি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় পড়ে। 'বিসিক থেকে নৌকার কারিগরদের ঋণের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।' জেলায় ২৭টি নদ-নদী থাকলেও অধিকাংশই পলি জমে ভরাট হয়েছে। তবে উপকূলীয় এলাকায় কিছু নদীতে খেয়া পারাপার ও মালামাল পরিবহনের কাজে এখনও প্রচুর নৌকা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া, মধু সংগ্রহ ও মাছের ঘেরে এসব নৌকার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।