ঢাকা বুধবার, ১৪ই মে ২০২৫, ৩১শে বৈশাখ ১৪৩২


শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম নাম বদলে ‘নীলা মার্কেট’


৫ নভেম্বর ২০১৯ ১১:১৭

আপডেট:
১৪ মে ২০২৫ ০৩:২৯

পূর্বাচলে ৭০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার যে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নির্মিত হচ্ছে তার নাম শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। কিন্তু এলাকাটি যাতে এই নামে পরিচিত হতে না পারে সে জন্য বারবার ‘নীলা মার্কেট’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে তা প্রচার করার অভিযোগ উঠেছে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার বিরুদ্ধে। তিনি কয়েক বছরে ব্র্যাক কর্মী থেকে সরকারি দলের ছায়ায় এসে অবৈধভাবে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জায়গায় বাজার বসিয়ে নীলা দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য করে আসছেন। এখন এর আশপাশে রাজউক পূর্বাচলের জায়গায় গড়ে তুলেছেন বাজারসহ নানা অবৈধ কারবারের আখড়া।

স্থানীয় লোকজন জানান, রাজউক অন্তত ৩০ বার নীলা মার্কেটের সাইনবোর্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, মার্কেট ভেঙেছে। কিন্তু প্রতিবারই ভাঙার পরদিন আবার নীলা মার্কেটের সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন নীলা।

এ জায়গায় নিজের নামে অমরত্ব চান ফেরদৌসী আলম নীলা। তিনি প্রায়ই দম্ভ করে বলেন, ‘আমি এক দিন বেঁচে থাকব না, কিন্তু এলাকার নামটা চিরদিন নীলা মার্কেট হিসেবেই থাকবে।’

এলাকার নাম নীলা মার্কেট অক্ষুণœ রাখতে তার আপ্রাণ চেষ্টাও দেখা গেছে সরেজমিনে। রাজউক সাইনবোর্ড ভেঙে দিলে পরদিনই তা নতুন করে লাগানোর পাশাপাশি একদল যুবককে ‘নীলা মার্কেটে আপনাদের স্বাগত’ বলে মাইকিং করতে দেখা যায়। এভাবে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এলাকার নাম বদলে দিচ্ছেন স্থানীয় এক নেত্রী।

স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, ফেরদৌসী আলম নীলা ব্র্যাকের একজন কর্মী ছিলেন। এরপর সরকারি দলে গিয়ে কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার, বৈধ-অবৈধ জমির মালিকানা, রাজধানীতে বহু দোকান, ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন অবৈধ পথে। তার অবৈধ আয়ের একটা বড় উৎস শেখ হাসিনা স্টেডিয়াম এলাকা।

নীলার বিপুল উত্থান এবং তাদের জীবনযাপন নিয়ে রূপগঞ্জের মানুষের মাঝে অপার কৌতূহল। নিলা ও তার স্বামী শাহ আলম ফটিক কিছুদিন পর পর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। একটি সূত্র জানায়, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ক্যাসিনোতে যাতায়াত রয়েছে নীলার।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যুবলীগ-আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার কোটি কোটি টাকা জব্দ ও তাদের উত্থানের সঙ্গে নীলার ফুলে-ফেঁপে ওঠার মিল খুঁজে পাচ্ছেন রূপগঞ্জের মানুষ।

রাজউকের বিশাল জায়গা দখলে নিয়ে নীলা মার্কেট, পূর্বাচল উপশহরে প্লট-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, বালুর কমিশন, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি প্রদান, আবাসন প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ, দখলবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ফেরদৌসি আলম নিলা ও তার স্বামী শাহ আলম ফটিকের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকজন সচিবের নাম ভাঙিয়ে নীলা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- করে যাচ্ছেন। নীলার দাপটে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাও টু-শব্দটি করেন না। এতে করে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মাঝে রয়েছে ক্ষোভ।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ভোলানাথপুর এলাকায় পাকা-আধাপাকা কয়েক শ দোকানঘর নির্মাণ করে বাজার বসানো হয়েছে। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি ও পরিচ্ছন্নতার নামে প্রতি দোকান থেকে আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে চাঁদাবাজ চক্র। বর্তমানে এসবের নিয়ন্ত্রণ করছেন নীলার দেবর আনোয়ার হোসেন। দোকানের সাইনবোর্ড দিতে হলে তাতে বাধ্যতামূলক ‘নীলা মার্কেট’ ঠিকানা লিখতে হয়।

এই বাজার ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। এসব আস্তানায় মেলে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। নির্জন জায়গা হওয়ায় সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য যুবক-যুবতী ঘুরতে এসে অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত হচ্ছে। বাজারের সামনেই একটি কবরস্থান। এর ভেতরেও মাদকের মজুদ গড়ে তুলে খুচরা কেনাবেচা চলছে। এসব জায়গা থেকে টাকা তুলে তা নিলার স্বামী শাহ আলম ফটিকের কাছে জমা দেয়া হয় বলে স্থানীয় সূত্র জানায়।

প্রতিদিন রাজধানীসহ আশপাশ এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন ভিড় জমায় এ বাজারে। এখানে বিশেষ ধরনের কয়েকটি রেস্টুরেন্টে যুবক-যুবতীদের আলাদাভাবে অবস্থানের জন্য রুম ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। ঘণ্টায় ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা ভাড়া। আশপাশে জুয়ার আসর বসানো হচ্ছে। এসব আসরে প্রতি রাতে লাখ লাখ টাকার খেলা হচ্ছে। এখানে জুয়া খেলতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও নরসিংদী, রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকজন আসে। মাদক ও জুয়ার স্পট থেকে প্রতিদিন আদায় হয় হাজার হাজার টাকা।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন ফেরদৌসী আলম নীলা। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক। এলাকার মানুষ আমার নাম ব্যবহার করলে আমার কী করার আছে!’

কিন্তু রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহামুদুল হাসান জানান ভিন্ন কথা। পুলিশের উপস্থিতিতে স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও ভাইস চেয়ারম্যান নিলা আবার বাজার বসান। ওসি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে নির্ধারিত স্টেডিয়ামের জমিতে ভাইস চেয়ারম্যান নীলা নিজের নামে বাজারের নাম দেয়ার সাহস করেন কীভাবে আমি জানি না।’

নীলার কার্যকলাপ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে জানান রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘রাজউকের অধীনে থাকা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামের নামের পরিবর্তে ’নিলা মার্কেট’ নাম দেয়ার বিষয়টি শুনেছি। ইতিমধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান নীলার বিষয়টি আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ ব্যপারে শিগগির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আর অন্যান্য বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখবেন।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, এ ধরনের কাজে কেউ জড়িত থাকলে তা নিন্দনীয়। রাজউক ও জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করেন তিনি।