ঢাকা বুধবার, ১৪ই মে ২০২৫, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


সড়কে এনায়েত উল্লাহর চাঁদাবাজির দাপট চরমে!


২৪ অক্টোবর ২০১৯ ১১:০৫

আপডেট:
১৪ মে ২০২৫ ১১:২৮

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ রাজধানী ও এর আশেপাশে বিভিন্ন রুটের প্রায় ১৫ হাজার বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তুলছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ বাস চালক ও মালিকদের। তারা বলছেন, দেশের পরিবহন খাত এনায়েত উল্লাহর কব্জায় জিম্মি। এ জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার দাবিও তাদের। এনায়েত উল্লাহ গত জোট সরকারের সময়েও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

তখন এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং বর্তমানে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস। বর্তমানে বিএনপি নেতা সেই খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ভোল পাল্টে নব্য আওয়ামী লীগ সেজে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সারাদেশে চাঁদাবাজি করছে। এতে মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। মহাজোট সরকারকে বিব্রত করার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ৬৫ বার পরিবহন ধর্মঘট দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন পরিচালিত হচ্ছে জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি হালাল করার জন্য তারা এই ফেডারেশনে মাত্র ২/১ জন আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলের প্রতিনিধি রেখেছেন। জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই ফেডারেশন প্রতিদিন রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে।

এসব অভিযোগে সম্বলিত একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই অভিযোগ অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই জামায়াত-বিএনপির।

এই ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ প্রতিদিন রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে ৫০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে। অভিযোগকারীদের দাবি স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও বাংলাদেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনও পরিবহন শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অভিযোগে জানা যায়, ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নীচপনুয়া গ্রামের বাসিন্দা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি ১৯৮৪ সালে গুলিস্তান মিরপুর রোডে একটি মিনিবাস দুইজনে পার্টনারে ক্রয় করে পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন। যার মূল্য ছিল মাত্র এক লাখ ৭০ হাজার টাকা। সেই এনায়েত উল্লাহ বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের হাত মিলিয়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেই সময়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মির্জা আব্বাস ও খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

সেই এনায়েত উল্লাহই আবার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মকবুল সাহেবের হাতে পায়ে ধরে স্ব-পদে বহাল থাকেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দায়িত্বগ্রহণ করেন এনায়েত উল্লাহ।

খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন টার্মিনালের দক্ষ শ্রমিক নেতাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে অদক্ষ গাড়ির শ্রমিক ও অদক্ষ শ্রমিক নেতা দ্বারা পরিচালিত করছেন ঢাকা শহরের সব কয়টি বাস টার্মিনালে। এতে করে সৃষ্টি হচ্ছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এবং সেইসাথে চলছে পরিবহনে মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজি। গাড়ি প্রতি নেয়া হচ্ছে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহর দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের বিশাল পাহাড়। ধানমন্ডিতে একটি ও গুলশানে কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। পূর্বাচল সংলগ্ন ৩০০ ফিট রাস্তার পার্শ্বে প্রায় শত বিঘা জমি। সারাদেশে এনা পরিবহন প্রায় আটশো’র বেশি গাড়ি রয়েছে। প্রতিটি গাড়ির মূল্য প্রায় এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সিলেটে কয়েক বিঘা জমির উপরে এনা পরিবহনের নিজস্ব গাড়ির টার্মিনাল। ময়মনসিংহ, ভালুকায় রয়েছে ২৩ বিঘা জমির উপর এনা ফুডস নামের বিশাল ফ্যাক্টরি। মালয়েশিয়া ও কানাডায় রয়েছে সেকেন্ড হোম। ময়মনসিংহে প্রায় শত বিঘা জমি। মিরপুর রয়েছে বহুতল ভবনের সাতটি বাড়ি। কক্সবাজার কুয়াকাটাতে আবাসিক হোটেল। হবিগঞ্জ-মাধবপুরে কয়েক বিঘা জমির উপর হোটেল। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে খন্দকার ফুড নামে একটি বিশাল রেস্টুরেন্ট রয়েছে। মহাখালীতে নিজস্ব জায়গায় বিশাল এনা পরিবহনের অফিস।

ভিক্টর ও আকাশ পরিবহনে ব্যানারের বাস মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সকালে বাস বের করার পরপর ঢাকা মালিক সমিতিও বিভিন্ন রুটের মালিক সমিতিকে (গেট পাস- জিপি) হিসেবে প্রতিটি গাড়ি বাবাদ দিতে হয় ১২ থেকে আঠারোশো টাকা। এরমধ্যে থেকে ত্রিশ ভাগ শ্রমিক ইউনিয়ন আর শ্রমিক ফেডারেশনে পাঁচ ভাগ টাকা। তবে এই টাকা কেন দিতে হবে তার সুস্পস্ট জবাব নেই কারো কাছে। আর চাঁদা না দিলে রাস্তা চলতে দেয়া হয় না বাস এমন অভিযোগ বাস মালিকদের। তারা মনে করছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হলে ভাড়ার পাশাপাশি কমবে দুর্ঘটনাও। এছাড়া সড়কে ও ফিরবে শৃঙ্খলা।

সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোজাহারুল ইসলাম সোহেল জানান, পরিবহন খাতে দৈনিক যে চাঁদা ওঠে। মাসে এই চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২ কোটি টাকায়। যার পুরোটাই যাচ্ছে সিন্ডিকেটের কাছে। এই সিন্ডিকেটে আবার আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জামায়াত মিলে একাকার। এর মধ্যে সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন। এরপর বিভিন্ন বাস মালিকরা বাস চালাতে দেন। এ জন্য বাস প্রতি দিতে হয় দুই থেকে বিশ লাখ টাকা।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, চাঁদাবাজির জন্য পরিবহন কোম্পানিগুলো দায়ী। তিনি দাবি করেন, আমি বা আমার সংগঠনের নাম মাত্র চাঁদা নেন। যা ব্যবহার করা হয় সংগঠনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে।