ঢাকা রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


ভুয়া তথ্যে পাসপোর্ট নিচ্ছে রোহিঙ্গারা


২৫ মে ২০১৯ ২৩:২৫

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৪:২৯

ভুয়া নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। পরে বাংলাদেশি এই পাসপোর্ট নিয়ে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। সম্প্রতি রাজধানীর মালিবাগের একটি বাসা থেকে ৫৪টি পাসপোর্ট উদ্ধার হয়। এরপর ওই পাসপোর্টের ব্যবহার ও তৈরিকারী জালিয়াত চক্রের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে এসব তথ্য পেয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ডিবির একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, ভুয়া নাম-ঠিকানায় পাসপোর্ট বানিয়ে অনেক রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত হবে, সে বিষয়টি তদন্তের পর জানা যাবে। এরই মধ্যে উদ্ধার হওয়া ৫৪টি পাসপোর্টে উল্লিখিত তথ্য গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে পুনঃযাচাই হচ্ছে। এতে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত জেলার সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের মাধ্যমে তথ্যগুলো ঠিক আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে।

ডিবির পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনার মোখলেছুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক তথ্যমতে উদ্ধার হওয়া পাসপোর্টগুলোর নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বরের সবকিছুই ভুয়া বলে মনে হয়েছে। এগুলোর সবই অফিশিয়ালি বের করা হয়েছে। এখন কারা ও কীভাবে বের করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। পাসপোর্টে যেসব ছবি ও নাম ব্যবহৃত হয়েছে তাদের বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও

খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’

উদ্ধার হওয়া একাধিক পাসপোর্টে উল্লিখিত তথ্য দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকেও যাচাই করা হয়েছে। এতে কোনো তথ্যেরই সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আয়েশা বেগমের নামে ইস্যু করা ইএ-০৩০৬৭৫৮ নম্বর পাসপোর্টে তার জন্মস্থান বলা হয়েছে ঢাকায়, জন্ম তারিখ লেখা হয়েছে ১৯৮৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। গত ৬ এপ্রিল ইস্যু করা পাসপোর্টটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ৫ এপ্রিল। এতে কুষ্টিয়া ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. বজলুর রশীদের সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে। পাসপোর্টটিতে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়ার পর ইমু পরিচয়ে এক নারী দেশ রূপান্তরকে জানান, আয়েশা নামে ঢাকায় তাদের কোনো স্বজন নেই। তার স্বামী মইনউদ্দিনকেও চেনেন না তিনি। এমনকি তাদের পরিবারের কারও পাসপোর্টই নেই। ওই নারী আরও জানান, তাদের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায়। তার স্বামী একজন মুহুরি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বর অন্যের পাসপোর্টে কীভাবে গেল, কিছুতেই তা বুঝতে পারছেন না তিনি।

ইএ-০৩৭৪০৩৮১ পাসপোর্টে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম দেওভোগের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে দেখানো হয়েছে মিনারা বেগমকে। অবিবাহিত এই নারীর বাবা ও মায়ের নাম লেখা হয়েছে যথাক্রমে বদি আলম ও মাকসুদা বেগম। কুষ্টিয়া ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অফিসের ইস্যু করা এ পাসপোর্টে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করে জানা যায়, এই নামে তাদের কোনো স্বজন নেই।

ডালিয়া নাসরিন লিজার নামে ইস্যু হওয়া ইএ-০১৯৬২৭৪৭ পাসপোর্টে সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে ঢাকার উত্তরার জোনের উপসহকারী পরিচালক মো. নাজমুল ইসলামের। এতে লিজার স্থায়ী ঠিকানা বলা হয়েছে, গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খৈলকুর এলাকায়। ওই পাসপোর্টে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

ডিবি পশ্চিম বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হান্নানুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি পাসপোর্ট তৈরির সময় নির্ধারিত ফরম পূরণের পাশাপাশি আবেদনকারীর জন্ম নিবন্ধন সনদ/জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। ছবি তোলার সময় আবেদনকারীকে পাসপোর্ট অফিসে হাজির হতে হয়। তার আগে সব কাগজপত্র পরীক্ষার পর প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার সত্যয়নের দরকার হয়। এতসব প্রক্রিয়ার পরও ভুল নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু হওয়ায় নানা শঙ্কা ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রথমে বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের বাছাই করে। পোশাক কারখানা ও বাসায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাদের ঢাকার কোনো আস্তানায় নিয়ে আসে। সিন্ডিকেটের স্থানীয় চক্রের হোতা আইয়ুব মোস্তাকিম তাদের রিসিভ করে। এরপর ভুয়া বাবা-মা ও স্বামীর নাম মুখস্থ করানোর পাশাপাশি স্থায়ী ঠিকানা শেখানো হয়। তারপর তাদের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হয়।’

তদন্তকারী ডিবির আরেক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী এই রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দেশে গিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার দায়ভার বাংলাদেশের ওপর বর্তায়। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নানা জটিলতার মুখে পড়বেন।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, উদ্ধার হওয়া ৫৪টি পাসপোর্টে উল্লেখ করা যাবতীয় তথ্য পুনঃযাচাইয়ের পাশাপাশি পাসপোর্ট যাচাইকারী সংস্থা পুলিশের বিশেষ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কি না সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কারা সত্যয়ন করেছে, জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করেছেÑএসব বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে।

গত শুক্রবার রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার একটি বাসা থেকে ২৩ রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। তারা জানতে পারেন, তাদের বিদেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশি সাজানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এই চক্রের মূল হোতা হাজি ইব্রাহিম খলিল ও আবদুস সবুর ওরফে রহিমের খোঁজে মালিবাগের একটি বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে পাচারচক্রের কোনো সদস্যকে পাওয়া না গেলেও ৫৪টি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রত্যেকটি পাসপোর্ট জরুরি ফি দিয়ে অফিশিয়ালি বের করা হয়েছে। এসব পাসপোর্টে উল্লিখিত নাম-ঠিকানা কেন যাচাই-বাছাই করা হয়নি, সে বিষয়ে এসবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

ওই ৫৪টি পাসপোর্টে বেশিরভাগ ব্যক্তিকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা দেখানো হয়েছে। এছাড়া কয়েকজনকে ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, গাজীপুর এবং ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এনামুল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ ও মোহাম্মদ সাদেককে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বাসিন্দা দেখানো হয়েছে। এছাড়া জাহিদ হোসেনকে বলা হয়েছে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে আরও আছেন আনোয়ার সাদেক, জাবের, রোকনু, দেলোয়ার হোসেন রাজু, এইচ এম জাহাঙ্গীর আলম, আলম মোহাম্মদ মোস্তাকিম, সোনিয়া, জসিমউদ্দিন, ইরফান, সাখাওয়াত হোসেন, হামিদুল হক, সিদ্দিক, আরিফ, আবদুল মোত্তালিব, রাশিদা আক্তার, সালমা বেগম, রাশিদা বেগম, সুফিয়া আক্তার, শিফা আক্তার, সালমা আক্তার, সাদেকা বেগম চৌধুরী, খুর্শিদা বেগম, সুমি আক্তার, মাজিদা বেগম, ওমর, শফি, আয়েশা আক্তার, সাজু, রফিকা আক্তার, মিসেস আয়শা ও নূর হাসিনা।