তুরিন আফরোজ : টাকা কামানোই যার নেশা

আইন-বিচার অঙ্গনে এখন আলোচিত-সমালোচিত নাম ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। ‘তুড়ি মেরেই’ মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ছিল যার কাজ। নিজের স্বার্থের বাইরে গেলে দেখাতেন মামলা-মোকদ্দমার ভয়। টাকা কামাতে প্রথিতযশা ব্যক্তিদেরও করতেন ব্ল্যাকমেইল। এমনকি ছাড়েননি খোদ মা-ভাইকেও। মূলত ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সিনিয়র প্রসিকিউটর হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এই আইনজীবী। পদের প্রভাব খাটিয়ে নানান কাজে আইনকেও দেখিয়েছেন বৃদ্ধাঙ্গুলি।
সূত্র জানায়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম হাতিয়ার ছিলেন তুরিন। সেই সুবাদে ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পান তিনি। আর দায়িত্ব নিয়েই জড়িয়ে পড়েন একাধিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে থাকলেও অর্থের কাছে হার মানেন এই ব্যারিস্টার। কয়েক কোটি টাকার লোভে গোপনেই দেখা করেন যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে।
ওয়াহিদুল ছিলেন এনএসআই ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তার বিরুদ্ধে হওয়া একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে তুরিনের কাঁধে। অনৈতিকভাবে ওয়াহিদুলের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ২০১৮ সালের মে মাসে তুরিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদটিও খোয়ান তিনি। মূলত নানান অপকর্মের কারণেই তাকে অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অথচ গ্রেফতারের পর ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলেই চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন’ বলে আদালতকে জানান ‘ধূর্ত’ এই আইনজীবী।
তথ্যমতে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে লড়েন তুরিন আফরোজ। এসব মামলা লড়তে গিয়েই আলোচনায় আসেন দেশজুড়ে। আর সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন শিল্প পরিবারের মালিককে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের মামলার ভয় দেখিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা; যার তথ্য উঠে এসেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তদন্তেও।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের ইসলামের নেতাকর্মীদের নারকীয় গণহত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন বলেও তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ২০ আগস্ট তুরিনসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়। এ তালিকায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের নামও রয়েছে।
প্রসিকিউটরের দায়িত্বে থাকতে বিচারপতি মানিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে মূল রাজাকারদের বাদ দিয়েছেন তুরিন আফরোজ। আর ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন নিরপরাধ ইসলামপন্থিদের। এমনটিই জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। এ ছাড়া কথিত গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের সঙ্গেও ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইমরানের বাসায় মদের আসর বসাতেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে এই আইনজীবীর বিরুদ্ধে। মেয়ের এমন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করাই কাল হলো মা-ভাইয়ের। ছাড়তে হয়েছে তাদের আপন ঠিকানা।
শুধু তাই নয়, জানা গেছে, পৈত্রিক সম্পত্তির লোভে নিজ মায়ের গায়ে লাগিয়েছেন ‘জামায়াতের রোকন’ তকমা, করেছেন হেনস্তা আর শারীরিক নির্যাতনও। ভাইকে বানিয়েছেন জামায়াত-শিবির। পাঁচ তলা বাড়িটি রাজধানীর উত্তরার রেসিডেন্সিয়াল মডেল টাউনের ১১ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর সেক্টরে।
এখানেই ২০০২ সাল থেকে বসবাস শুরু করেন তুরিনের মা শামসুন নাহার ও ভাই শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজ। তবে ২০১৭ সালে প্রভাব খাটিয়ে তাদের বের করে দেন তুরিন। পরে বাড়ির ভোগদখল নিয়ে ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন তার ভাই। কিন্তু উল্টো মালিকানা দাবি করে একই আদালতে মামলা ঠুকে দেন এই আইনজীবী। ব্যারিস্টার মেয়ের বিরুদ্ধে এ নিয়ে একাধিক সংবাদ সম্মেলন করেন মা শামসুন নাহার তাসলিম। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর দুই পক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে বাড়িটি ভোগদখলের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা জারি করেন ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। সম্প্রতি মামলায় জিতেছেন তুরিনের মা আর ভাই।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের তুরিনের মা বলেছিলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ প্রতিনিয়তই আমাকে জামায়াতের রোকন বলে অপপ্রচার চালিয়ে যেতো তুরিন। এমন অপপ্রচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমাকে উত্তরার বাসা থেকে বের করে দেয়। এখন সরকারে রয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাসা ফেরত পেতে আমি তার কাছে সহযোগিতা চাই।’
ব্যারিস্টার তুরিনের সবচেয়ে বেশি সমস্যা ছিল ইসলামপন্থিদের নিয়ে। ইসলামপন্থি রাজনীতিতে অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ এনে ১১৬ জন ধর্মীয় বক্তার একটি তালিকা জমা দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে এ তালিকা তুলে দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তথাকথিত গণকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তার সঙ্গে ছিলেন তুরিন আফরোজ। এতে এক হাজার মাদরাসা ও ১১৬ জন ইসলামী চিন্তাবিদ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। মঙ্গলবার তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইনের আদালত।
আইনজীবী মনোয়ার পাটোয়ারী বলেন, ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ওয়াহিদুল হকের মোবাইলে যোগাযোগ করেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে বলে দেখা করতে চেয়েছেন তিনি। তবে দেখা না করলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির হুমকি দেন তিনি। ওই সাক্ষাতে ঘুষের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তুরিন। তার এমন আচরণ একেবারেই অপেশাদার ছিল। মূলত মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওয়াহিদুলকে বাঁচাতে চেয়েছেন তিনি। এক কথায় টাকার জন্য যেকোনো কাজই করতেন তুরিন।