ঢাকা মেডিকেলে খাদ্য টেন্ডারে কোটি টাকার সিন্ডিকেট
অবিশ্বাস্য কম দরে কাজ, কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

দেশের সর্ববৃহৎ চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) রোগীদের খাদ্য সরবরাহের টেন্ডার নিয়ে আবারও বড় ধরনের অনিয়ম ও সিন্ডিকেট কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। প্রায় দুই কোটি টাকার সর্বোচ্চ দরপত্রকে পাশ কাটিয়ে মাত্র ১৫ লাখ টাকায় একটি রহস্যময় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের তৎপরতা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
অস্বাভাবিক দর ও সিন্ডিকেটের ছায়া
সাম্প্রতিক এক টেন্ডারে (ই-জিপি আইডি: ১০৭৮৯৫৩) এই অসঙ্গতি সামনে আসে, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল। টেন্ডারটিতে "রাজু ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল" নামে একটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সর্বোচ্চ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দর প্রস্তাব করে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে কাজটি দেওয়া হয় "ইসকো ট্রেডিং কোং" নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে, যাদের প্রস্তাবিত দর ছিল মাত্র ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ টাকা।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে "রাজু ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল" গত ২৫ এপ্রিল ও ৪ মে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগে বলা হয়, সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচনে প্রচলিত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (PPR) লঙ্ঘন করে "OSTM" নামক একটি অবৈধ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত এবং এর মাধ্যমে তাদের ন্যায্য অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
টেন্ডারের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইসকো ট্রেডিং কোং-এর অস্বাভাবিক কম দরের বিপরীতে অন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানের দর ছিল প্রায় কাছাকাছি। হোসাইন সাকিক ইন্টারন্যাশনাল বিডি, আফরোজা এন্টারপ্রাইজ, খান ব্রাদার্স, সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ, নবি এন্টারপ্রাইজ এবং জেক ইন্টারন্যাশনাল—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দর ছিল ১৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা থেকে ১৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৮০ টাকার মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি প্রতিষ্ঠানের দর এত কম এবং বাকি সবার দর প্রায় একই হওয়াটা পরিকল্পিত সিন্ডিকেট বা ‘বিড রিগিং’-এর স্পষ্ট লক্ষণ।
সিন্ডিকেটের নেপথ্যে কারা?
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন খালেক রাজু (ওরফে টুকাই রাজু), যিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেট বিভিন্ন বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে হাসপাতালের টেন্ডার ও সরবরাহ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর খালেক রাজু তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে "জেক ইন্টারন্যাশনাল" এবং "ইসকো ট্রেডিং কোং"-এর মতো নতুন কোম্পানিকে সামনে নিয়ে আসেন। বর্তমান টেন্ডারে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ এবং ইসকো ট্রেডিং কোং-এর রহস্যজনকভাবে কাজ পাওয়া পূর্বের অভিযোগগুলোকে আরও জোরালো করেছে।
রোগীর খাবার নিয়ে কারসাজি
টেন্ডার দুর্নীতির এই অভিযোগের সরাসরি প্রভাব পড়ছে রোগীদের খাবারের মানের ওপর। হাসপাতালটিতে সাধারণ ওয়ার্ড, কেবিন/পেডিয়াট্রিক এবং আইসিইউ/এইচডিইউ-এর মতো বিভিন্ন ক্যাটাগরির রোগীদের জন্য দৈনিক খাদ্য বরাদ্দ জনপ্রতি ১৭২ টাকা। কিন্তু প্রতিটি ক্যাটাগরির মেনু ও উপকরণের পরিমাণ ভিন্ন। একই মূল্যে কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন মানের ও পরিমাণের খাবার সরবরাহ করা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মেনু বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খাবারের মূল্য ও পরিমাণে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে, যা রোগীদের প্রাপ্য পুষ্টি নিশ্চিত করে না। কম মূল্যে টেন্ডার নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে গুণগত মান বজায় রাখবে, তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা।
কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের তীর
এই সিন্ডিকেট পরিচালনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এবং ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা. আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে সরাসরি সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীদের মতে, তারা দুজনই গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কাল থেকেই দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত এবং এই সময়ের মধ্যেই একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে তা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগ আরও গুরুতর হয়েছে যখন বলা হচ্ছে, পরিচালকের স্ত্রী নিজেই ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করেন এবং উপ-পরিচালক ডা. আশরাফুল আলম তাকে এই অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেন। এর পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম, ডা. মশিউর রহমান (এসএলপিপি), টেন্ডার শাখার আব্দুল আউয়াল লিটন ও সুমন দে, ক্যাশিয়ার আলমগীর, প্রধান সহকারী জাহাঙ্গীর, ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ এবং মেডিসিন স্টোরের জসিম ও মনির সহ আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে এই চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগকারীদের মতে, এরা সবাই ঢাকা মেডিকেলের ওষুধ চুরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত।
এর আগেও একটি টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাদ দিয়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় হাসপাতালের প্রায় ৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা তাদের ভূমিকা এবং স্বচ্ছতাকে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তদন্তের দাবি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক অনিয়ম, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এবং রোগীদের জীবন ও স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই পরিস্থিতিতে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা অপরিহার্য। অভিযোগগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে হাসপাতালের সেবার মান পুনরুদ্ধার এবং জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।