ঢাকা মঙ্গলবার, ২১শে জানুয়ারী ২০২৫, ৯ই মাঘ ১৪৩১


ভবিষ্যৎ আমলাতন্ত্র কেমন চাই


৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:৪২

আপডেট:
২১ জানুয়ারী ২০২৫ ২৩:৩৯

মোটাদাগে 'আমলাতন্ত্র' হল সরকারের অনির্বাচিত অংশ যারা সরকারের হয়ে কাজ করে থাকেন। আমলাতন্ত্রের কর্মচারীরা সরকারের অনুগত থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু নিয়ম নীতির প্রশ্নে কঠোর অবস্থানে থাকার কথা থাকলেও তার ব্যত্যয় ঘটেছে সবসময়ই।

ম্যাক্স ওয়েবার যে আধুনিক আমলাতন্ত্রের কথা বলেছেন তাতে নির্দিষ্ট পদসোপানের কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে নিয়ম নীতির প্রশ্নে কঠোর অবস্থানের কথা। কিন্তু পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব মুখ্য হয়ে দাঁড়ালে প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমলাতন্ত্রের এই মূলনীতিসমূহ।


আমলাতন্ত্রের প্রতিটি স্তরে যে অপরাজনীতি প্রভাব বিস্তার করেছিল তা জুলাই গণবিপ্লবের পর প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও জননীতির চেয়ে ক্রমশ দলীয় অনুগত রাজনীতি আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হয়ে উঠেছিল।

এর ফলে আমাদের আমলাতন্ত্র জবাবদিহিমূলক এবং স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারংবার।
আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে না পারলে স্বনির্ভর রাষ্ট্রভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে। আর ঠিক এ কারণেই স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমলাতন্ত্রের সাথে জড়িয়ে আছে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, দীর্ঘসূত্রিতা, জনসাধারণের হয়রানির কথা। এর সাথে যখন যোগ হয় রাজনৈতিক প্রভাব, তখন আমলাতন্ত্রের প্রকৃত সুফল পেতে ব্যর্থ হয় দেশের জনগণ।
উদাহরণস্বরূপ প্রশাসন ক্যাডারের কথা বলা যাক। একজন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার( ভূমি) তার অধিক্ষেত্রে অনেক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব তার ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রকে করে সংকুচিত।

তাকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপোষ করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। এর ফলে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করছে যে সরকার তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
অন্যান্য ক্যাডারের প্রসঙ্গ যদি আনা হয়, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের অফিসারগণ জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিতের কাজ করে থাকেন।

সুতরাং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতকে আরো কতবেশি জনবান্ধব করা যায় সেদিকে কাজ করা অপরিহার্য।
এ প্রসঙ্গে চলে আসা সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত উপসচিব পদে কোটা বিষয়টি। এটি সরকারের পদ নাকি নয় বা এর আসল পদধারী কারা হবে বা কোন ক্যাডার হবে এই আলোচনায় যাচ্ছি না।
বরং স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মত জনগুরুত্বপূর্ণ খাত থেকে পর্যাপ্ত দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা শিক্ষাবিদ তৈরি হবার পরিবর্তে কতিপয় ব্যক্তি ' উপসচিব' পদে পদায়িত হওয়া রাষ্ট্রের জন্যে কতটা সুবিধাজনক, এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

জেনারেলিস্টরা তাদের মাঠ পর্যায়ে সমন্বিত জ্ঞান দ্বারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। কোন টেকনিকাল পরামর্শের জন্যে টেকনিকাল টিমের দ্বারস্থ হতেই হয়৷ সেটা যে কোন রাষ্ট্রই করে থাকে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কোনরূপ অভিজ্ঞতা ছাড়া কেবলমাত্র পেশাগত জ্ঞান আমলাতন্ত্রকে দুর্বল করে কেবল। কারণ আমলাতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট পদসোপানের ওপর দাঁড়িয়ে। আর এটিই বাধাগ্রস্ত হয়।

এই যে জেনারেলিস্টদের সাথে পেশাজীবীদের দীর্ঘদিনের এই দ্বন্দ্ব কতটা মনস্তাত্ত্বিক আর কতটা যৌক্তিক এর সমাধানও রাষ্ট্রকে করতে হবে।
কারণ প্রতিটি ক্যাডার কোন না কোনভাবে আমলাতন্ত্রের অংশ। একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্রমশ ক্ষতির মুখে পড়ে গোটা ব্যবস্থা। আমলাতন্ত্রের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো আমরা তৈরি করতে পারিনি স্বাধীনতার এত যুগ পরেও।
আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সুসংহত করা তাই ভীষণ জরুরি, যেমন জরুরি আমলাতন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সচল করা।

সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক আমাদের দিন