ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৯ই অক্টোবর ২০২৫, ২৪শে আশ্বিন ১৪৩২


নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর ১৫৬তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপন


প্রকাশিত:
৬ অক্টোবর ২০২৫ ২০:২৪

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট-এর আয়োজনে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ীতে মহাত্মা গান্ধীর ১৫৬তম জন্ম বার্ষিকী এবং আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস-২০২৫ পালন করা হয়েছে। রোববার (৫ অক্টোবর) সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগে অবস্থিত ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপন করা হয়।

দিবসটি পালন উপলক্ষে মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, সম্প্রীতি সমাবেশ ও মতবিনিময় সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কর্মসূচির শুরুতে ট্রাস্টের সচিব রাহা নব কুমার অতিথিবৃন্দ এবং সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন করেন এবং এরপর মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।

ট্রাস্টের সচিব রাহা নব কুমারের সভাপতিত্বে এবং পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) শংকর বিকাশ পালের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় ‘‘Fostering Global Solidarity Through Non-Violence” (অহিংসার মাধ্যমে বিশ্ব সংহতি গড়ে তোলা) প্রতিপাদ্যের আলোকে ধারণাপত্র পাঠ করেন সহকারী পরিচালক (মিডিয়া, কমিউনিকেশন এন্ড এইচ আর) অসীম কুমার বকসী।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাস, বিশেষ অতিথি হিসেবে সোনাইমুড়ী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাছরিন আকতার, রামগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ দিদারুল ইসলাম, বিশিষ্ট সমজকর্মী ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ব্রজ কিশোর সাহা সভায় বক্তব্য রাখেন।

ধারণাপত্রের আলোকে মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড এ্যাকশন নেটওয়ার্ক (PRAAN) এর নির্বাহী পরিচালক জনাব নুরুল আলম মাসুদ, জয়াগ ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ মহিন উদ্দিন, ভাওর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তার, জয়াগ ইউনিয়ন মানবাধিকার কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন পাখি, বজরা ইউনিয়ন মানবাধিকার কমিটির সহ সভাপতি সবুর উদ্দিন, লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা ইউনিয়ন মানবাধিকার কমিটির সভাপতি আজিজুর রহমান, জয়াগ বাজার কমিটির আহবায়ক হারুনুর রশীদ, নারী নেত্রী এবং জয়াগ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার বুলু আক্তার, চাটখিল উপজেলার মোহাম্মাদপুর ইউনিয়ন মানবাধিকার কমিটির সভাপতি কামাল মজুমদার, পাঁচগাও ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের মেম্বার মারজাহান আক্তার প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যেব গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাস বলেন, 'মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ সমগ্র বিশ্ববাসীর শান্তির জন্য। বর্তমান বিশ্বের সহিংসতা, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, নানা রকম বৈষম্য এবং দারিদ্রের কবল থেকে মুক্তির কথা বলতে গেলেই মহাত্মা গান্ধীজির আদর্শ আগে মনে আসে। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন শান্তি, সম্প্রীতি আর অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা। সে কারণে আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্ণধার ডক্টর মার্টিন লুথার কিং এবং দক্ষিন আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের খ্যাতিমান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা গান্ধীজির আদর্শ দ্বারা উজ্জীবিত হয়েছিলেন এবং যা প্রায়শঃ স্পষ্ট হয়েছে তাঁদের উদ্ধৃত উক্তির মাধ্যমে। আফ্রিকায় বসবাসরত ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার মধ্যদিয়ে মূলতঃ গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে তাঁকে মহাত্মা উপাধিতে ভূূষিত করেন। ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে তিনি কংগ্রেসের ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন।'

তিনি আরো বলেন, 'রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন গনতন্ত্রে। অস্পৃশ্যতা বর্জন, প্রাথমিক শিক্ষা, নারী প্রগতি, সাম্প্রদায়িক ঐক্য, প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকার, পঞ্চায়েত প্রথা, রাষ্ট্রনীতি, নির্বাচন প্রভৃতি বেশ কিছু নতুন পদ্ধতির প্রস্তাবক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি ভারতে বৃটিশ শাসন লোপের প্রচেষ্টায় বৈপ্লবিক ধারায় যে অহিংস আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন ‘সত্যাগ্রহ’ যার অর্থ স্বতঃপ্রণোদনায় নিজেকে দুঃস্থ আর্তদের কাছে আত্মসমর্পন। গান্ধীজি ছিলেন পরামর্শদাতা, শান্তি ও সৌহার্দ্যরে প্রতীক অন্যদিকে অহিংস আন্দোলনের পথিকৃত। তাঁর অহিংস-শান্তি-সম্প্রীতি দর্শনের প্রেক্ষিতে “সত্যাগ্রহ” এবং ৭টি “সামাজিক পাপ” সম্পর্কিত তত্ত¡ সমস্ত বিশ্ববাসীর বিবেকবোধে প্রণোদনা জুগিয়েছে। তিনি ৭টি “সামাজিক পাপ” যথাঃ নীতিহীন রাজনীতি, নৈতিকতাবিহীন বানিজ্য, শ্রমহীন সম্পদ, চরিত্রহীন শিক্ষা, মানবিকতাবিহীন বিজ্ঞান, বিবেকবর্জিত আনন্দ, ত্যাগহীন অর্চনা চিহ্নিত করেছেন যা মানুষের মানবিক মূল্যবোধ এবং উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে সমাজ জীবনে শান্তি বিনষ্ট করে। গান্ধীজি সেজন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় আজীবন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশা-দলমত-ভাষা-ভৌগলিক সীমারেখা-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানব কল্যানে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত খেলাফত আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। গান্ধীজি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ প্রচেষ্টার মধ্যে সমম্বয় সাধনের উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন যে কারণে তিনি খাদি আন্দোলন করেন।'

অন্যান্য অতিথি ও আলোচকবৃন্দ তাদের বক্তব্যে বলেন, 'মানব সভ্যতার আধুনিক যুগে বিভিন্ন সংকট নিরসনকল্পে এবং সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সেগুলোর বাস্তবায়নের ফলে মানব জাতি যখন সফলতার স্বাদ পাচ্ছে কিন্তু তারপরেও বর্তমান বিশ্বকে ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ তাড়া করছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো পরিবার, এলাকা বা দেশ সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এতে নারী ও শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ ব্যতিরেকে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, সহিংসতা কমবেশী লেগেই আছে। সামাজিক ক্ষেত্রে যে সহিংসতা সেখানেও রয়েছে নানা রকম বৈষম্য। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বহুমাত্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা গ্রহণ করার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অর্থবহ করে তুলতে পারি নাই। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, নীতিহীনতা, নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজ ও ধর্মীয় ভিত্তিতে দুূর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, যানবাহন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ সহ নানাস্থানে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটছে। ফলে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে মধ্যে দেখা দেয় সংশয়, সন্দেহ, আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাস যা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, মানবাধিকার এবং সামাজিকভাবে সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা-দলমত-ভাষা-ভৌগলিক সীমারেখা-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একত্রে বেঁচে থাকার রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা এবং অবিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে। এই অনুভবের জায়গা থেকে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট একটি জনকল্যানমুখী, অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বস্তরের শান্তিকামী মানুষের সাথে একই সুরে সুর মিলিয়ে সবার জন্য বাসযোগ্য, মানবিক এবং দারিদ্র্যহীন সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াসে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ তথা শান্তি-সম্প্রীতি-অহিংসা-সহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলি নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারাভিযাণ চালানোর প্রয়াস গ্রহণ করেছে।'

আলোচকগণ আরও বলেন, 'মহাত্মা গান্ধী নোবেল পুরস্কার পাননি। কিন্তু তাঁর ভাবশিষ্যদের অনেকে যেমন- দালাইলামা, বারাক ওবামা, কৈলাশ সত্যার্থী শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মহাত্মা গান্ধীর নোবেল পুরস্কার বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে নিহিত আছে। মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবন, রাষ্ট্রীয় পর্যায় সহ বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা মোকাবেলা, বৈষম্য প্রশমন এবং অশান্তি নিরসনে মহাত্মা গান্ধীজির অহিংস নীতি এবং সম্প্রীতির দর্শনকে লালন-পালন, চর্চা, প্রয়োগ এবং বিস্তারণ ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা এখন প্রত্যেক শান্তিকামী মানুষের দাবী, সময়ের দাবী। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গান্ধীজির দর্শন খুবই প্রাসঙ্গিক।'

অনুষ্ঠানে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মানবাধিকার ও সুশাসন বিষয়ক কর্মসূচির আওতাধীন ইউনিয়ন কমিটি এবং উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ১৫০ জন নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানের শেষাংশে, সাংস্কৃতিক পর্বে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের থিয়েটার ইউনিটের শিল্পীবৃন্দ এবং গান্ধী মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।