ঢাকা সোমবার, ২১শে এপ্রিল ২০২৫, ৮ই বৈশাখ ১৪৩২


খুলনা

আবারও লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, তদারকির ঘাটতির অভিযোগ


২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৩৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৩৯

রমজানে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দুই সপ্তাহের ব্যবধানে হঠাৎ করে ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করেছে, যার প্রভাব ইতোমধ্যে খুলনার বাজারে পড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগের ৩০-৩৫ টাকার পেঁয়াজ এখন খুলনার পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে। নগরীর পাইকারি বাজার ঘুরে সেই পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৬০ টাকায়। শনিবার ( ১৯ এপ্রিল) দিনজুড়ে নগরীর পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। তদারকির ঘাটতিতে এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের।

হঠাৎ করে পেঁয়াজের বাড়তি দামের কারণ হিসাবে জানা গেছে, বাজারে সরবরাহের জন্য কৃষকের কাছ থেকে যারা সরাসরি পেঁয়াজ কেনেন, তারা সেই পেঁয়াজ বাজারে না ছেড়ে অবৈধভাবে মজুত শুরু করেছেন। ওই চক্রটি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের অজুহাত সামনে এনে বাজারে অস্থিরতার পাঁয়তারা করছে। এমন অজুহাতে পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে দেশের উৎপাদিত পেঁয়াজের অবৈধ মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

খুলনার বাজারে পেঁয়াজের এমন দামের পরিবর্তনে ক্রেতা সাধারণ দিশেহারা এবং সামনে আরও দাম বৃদ্ধির ব্যাপারেও শঙ্কিত। পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ ক্রেতারা। পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি ও সামনে আরও দাম বাড়তে পারে এমন শঙ্কায় অধিকাংশ ভোক্তারা বাড়িতে পেঁয়াজ মজুত করছেন। যে কারণে স্বাভাবিক কেনাবেচার তুলনায় বর্তমানে নগরীর বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা বেশ বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় পেঁয়াজের বাজার রমজানের মতো সহনীয় রাখতে সাধারণ ভোক্তারা সংশ্লিষ্টদের প্রতি অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত বাজার তদারকির দাবি জানিয়েছেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনা সূত্র থেকে জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম কারা বাড়িয়েছে, তা চিহ্নিত করে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) খুলনা নগরীর পাইকারী পেঁয়াজের বাজার ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে খুলনায় ঝিনাইদহের শৈলকূপা, লাঙ্গলবাঁধ, ফরিদপুর রাজবাড়ীর পানশা, কুষ্টিয়ার কুমারখালি, পানথি, চৌরঙ্গী, রাশগ্রাম, শ্মশান, চাঁকমোহড়া, হাজিরহাটসহ বিভিন্ন হাট ও মোকাম থেতে বাজারে সরবরাহের জন্য কৃষকের কাছ থেকে যারা সরাসরি পেঁয়াজ কেনেন, তারা সেই পেঁয়াজ বাজারে না ছেড়ে অবৈধভাবে মজুত শুরু করেছেন। পাশাপাশি বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহের জন্য পাইকাররা পেঁয়াজের যে দাম বলছেন, তারা (মজুতকারী) কয়েক মাস পর বাড়তি দামে ওই পেঁয়াজ বিক্রির হিসাব ধরে বাড়তি দামে কিনছেন। যে কারণে মোকামে বা হাটে পেঁয়াজের দামে বর্তমানে ঊর্ধ্বগতি। তারা (ব্যাপারীরা) বলছেন, যদি পেঁয়াজের অবৈধ মজুত বন্ধ করা যায়, তবে দাম আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বর্তমানে মোকামে প্রতি মন পেঁয়াজ কেনা লাগছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা দরে। সে হিসাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ে ৪৫-৪৭ টাকা। এরপর পাইকারি ঘর পর্যন্ত পৌঁচ্ছাতে খরচ রয়েছে। সামান্য লাভে তো বিক্রি করতেই হয়।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিপরীতে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা নগরীর পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে খুচরা বাজারে বিক্রি করি। যে সময় যে দামে কিনি, সেই সময় সেই দামে বিক্রি করি, সামান্য লাভে বিক্রি করি। খুলনা বাজারে পেঁয়াজের হঠাৎ ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে সাধারণ ভোক্তারা বলছেন, প্রতি বছর পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে থাকেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইতোমধ্যে সিন্ডিকেট শুরু হয়ে গেছে। ঈদের আগে অর্থাৎ রমজানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ তারা কিনেছেন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে। ঈদের পর তা ৪০ টাকা এবং এখন কেনা লাগছে ৬০ টাকা দরে। শনিবার নিউ মার্কেট, ময়লাপোতা খুচরা বাজারে পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৬০ টাকা ও দৌলতপুর বাজারে ৫৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে দেখা গেছে।

দৌলতপুর পাইকারি কাঁচা বাজারে আসা ক্রেতা জাহিদ জানান, বাজারে ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। রোজা ও ঈদে বাজারে এক প্রকার স্বস্তি ছিল। হঠাৎই অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে নাজেহাল করে ফেলছে। যে পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কিনতাম, এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় কেনা লাগছে। পেঁয়াজের দামের এমন গতি দেখে মনে হচ্ছে সামনে দাম আরও বাড়বে। সরকারের উচিত হবে রোজা ও ঈদে যেভাবে বাজার তদারকি করে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, এখনো একইভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এতে আমাদের মতো ভোক্তারা একটু হলেও স্বস্তিতে থাকবে।

কেসিসির সোনাডাঙ্গা পাইকারী বাজারে ব্যবসায়ী মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে চাহিদার কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ভোক্তা ভাবছে সামনে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে, ওই শঙ্কায় তারা বাসা-বাড়িতে পেঁয়াজ মওজুদ শুরু করেছে। এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এল.সি পেঁয়াজ আসবে না, ওই শঙ্কায় পেঁয়াজ মজুত করছে। এ কারণে চাহিদা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদার কারণে দাম বাড়তি। তবে আশা করা যাচ্ছে সামনে দাম কমে যাবে।

মের্সাস জোনাকী ভান্ডারের সত্বাধিকারী আবু সুফিয়ান জানান, বর্তমানে মোকামে পেঁয়াজের দাম বেশি। মোকামে মজুত করার জন্য কৃষকের কাছ থেকে অনেকে বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনছে। যে কারনে ব্যাপারীদেরও বাজার ঠিক রাখতে বাড়তি দামে পেঁয়াজ কেনা লাগছে। ওই প্রভাব গোটা বাজারের উপর পড়ছে।

খুচরা বিক্রেতা হারুন মোড়ল জানান, ‘দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী বিক্রি করি। তবে যতটুকু জানি পেঁয়াজ মজুত করার কারণে দাম বাড়তি।’

নগরীর ময়লাপোতা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কাওসার জানান, সোনাডাঙ্গা পাইকারি বাজার থেকে বাছাই করা পেঁয়াজ ৫৪ টাকা কেজি দরে কেনা লাগছে। এরপর খরচ আছে, খুচরা ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি। যে সময় যেমন কেনা, সেই সময় সময় তেমন দামে বিক্রি করি। রাখি বা মজুতের কারণে বর্তমানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।

নগরীর নিউ মার্কেট বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কালু জানান, দাম তো আর আমাদের হাতে নেই। পাইকারি বাজার হতে যে দামে কিনি, সামান্য লাভে বিক্রি করি। গতকাল সোনাডাঙ্গা পাইকারি বাজার থেকে ৫৩ টাকা দরে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনেছি। খরচ-খরচা বাদে কয় টাকা দরে বিক্রি করব বলেন। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি। যখন দাম কমবে, তখন কম দামে বিক্রি করব।

এ ব্যাপারে সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই খুদা জানান, সরকার রমজানে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে করলেও সিন্ডিকেট কিন্তু এখনো সক্রিয়। তার প্রমাণ কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুন হয়েছে। সিন্ডিকেটদের যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, যদি বাজার তদারকি জোরদার না করা যায়, তবে বাজার আবার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। পেঁয়াজের সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কঠোর ভূমিকায় থাকতে হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মাদ সেলিম জানান, খুলনার নিত্যপণ্যের বাজারে আমরা নিয়মিত তদারকিসহ অভিযান অব্যাহত রেখেছি। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত করলে ওই ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা হিসাবে জরিমানা আরোপসহ আদায় করা হচ্ছে। যেহেতু পেঁয়াজের মজুতকে কেন্দ্র করে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে অবগত করা হয়েছে, এ ব্যাপারে বাজার তদারকির করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কোনো ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান সরকার প্রদত্ত নিয়মনীতির বাইরে ব্যবসা পরিচালনা করলে তাদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।