ঢাকা শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন

মহাস্থানে মিলল আড়াই হাজার বছর আগের ‘বাণিজ্যিক কেন্দ্র’


৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৩২

আপডেট:
১৮ মে ২০২৪ ২১:১১

বগুড়ার মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বেরিয়ে এসেছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। সেইসঙ্গে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়াব্দ থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনামলের সমৃদ্ধ প্রত্ন সামগ্রীও পাওয়া গেছে এবারের খননে। সেখান থেকে প্রাপ্ত প্রত্ন সামগ্রী নিশ্চিত করেছে মহাস্থানগড় প্রাচীন যুগেও ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে ছিল সমৃদ্ধ।

প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরী ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান মহাস্থান গড়ে বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ খননকালে এসব নিদর্শনের সন্ধান মেলে। গত মাস থেকে এ খনন কাজ শুরু হয়।


মহাস্থান গড় ঐতিহাসিকস্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে খনন করা হয়েছে। খননের বিভিন্ন পর্যায়ে এখানে বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রত্ননিদর্শন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকার যৌথভাবে খনন কাজ পরিচালনা করে আসছে। পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নেও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন পরিচালনা করছে। এবারও গড়ের বৈরাগীর ভিটার পাঁটি স্থানে শুরু হয় খনন কাজ। এর মধ্যে ফ্রান্স দল তিনটি এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দুটি স্থানে খনন কাজ পরিচালনা করে।

বৈরাগীর ভিটায় ২০১৭ সালে খননের পর প্রায় এক হাজার ৩০০ বছর আগে নির্মিত তিনটি বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন মেলে। এবার ওই খননস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে খনন করা হয়। খননকালে যেসব প্রত্ন নিদর্শন মিলেছে তা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, বৈরাগী ভিটার এই জায়গাটি কোনো বাণিজ্যিক কেন্দ্র অথবা খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্র ছিল। কারণ খননকালে পাশাপাশি এই পাঁচটি জায়গায় মোট আটটি কূপের সন্ধান মিলেছে। সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে বেশকিছু মৃৎ পাত্র, মৃৎ পাত্রের ভগ্নাংশ, মাটির বিশালাকায় একটি ডাবর (মটকা)।

খনন দলের সদস্যরা ধারণা করছেন, জায়গাটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। খননস্থলে প্রাপ্ত স্থাপত্য কাঠামো এবং উত্তরাঞ্চলীয় উজ্জ্বল চকচকে কালো মৃৎপাত্র (এনবিপিডাব্লিউ) দেখে খনন সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, এসব খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়াব্দ অর্থাৎ মৌর্য আমলের। সেই হিসেবে খনন থেকে প্রাপ্ত ও উন্মোচিত প্রত্নসামগ্রী প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন।

গত ৮ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া যৌথ খননে ফ্রান্সের পক্ষে দল নেতা ছিলেন কলিন লেফ্রাংক। তার সঙ্গে ছিলেন ফ্রান্সের এলবো ফ্রাংকোয়িস ও আতোয়ান। বাংলাদেশ দলের পক্ষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানার সঙ্গে ছিলেন প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মজিবুর রহমান, শাহজাদপুর জাদুঘরের কস্টোডিয়ান মোহাম্মদ যায়েদ, মহাস্থান জাদুঘরের কস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা, সিনিয়র ড্রাফসম্যান আফজাল হোসেন, আলোকচিত্রী আবুল কালাম আজাদ ও সার্ভেয়ার মুর্শিদ কামাল ভূঁইয়া।

খনন দলের সদস্য মোহাম্মদ যায়েদ জানান, এবার যেসব কূপের সন্ধান মিলেছে, তার মধ্যে একটি কূপ একেবারেই ব্যতিক্রম। ইতিপূর্বে যত খনন পরিচালিত হয়েছে সেসব খননে কোথাও ইটের গাঁথুনি বিশিষ্ট কূপের সন্ধান মেলেনি। কিন্তু এবারই প্রথম তেমন একটি কূপের সন্ধান মিলেছে বৈরাগীর ভিটায়। এই কূপের প্রায় ৬ ফুট গভীর পর্যন্ত তারা এবার খনন করে ৪৬ সারি ইটের গাঁথুনি উন্মোচন করেছেন। এ ছাড়া অন্য সাতটি পাতকুয়া বলে তিনি উল্লেখ করেন।

মোহাম্মদ যায়েদ আরও জানান, ইটের গাঁথুনি বিশিষ্ট কূপটি সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দী অর্থাৎ পাল আমলের। অন্যান্য কূপও সমসাময়িক সময়ের। সেই হিসেবে প্রায় ১৩০০ বছর আগে এই অঞ্চলে ইটের গাঁথুনি বিশিষ্ট কূপ থেকে মানুষ পানি সংগ্রহ করেছে।

মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা বলেন, মহাস্থানগড়ের প্রাচীনত্ব বিশ্ব স্বীকৃত। সেই স্বীকৃতির নিদর্শনই প্রতি বছরের খননকাজে উন্মোচিত হচ্ছে। সেখানে যেসব প্রতœবস্তুর নমুনা মিলেছে, তা প্রমাণ করে খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বেও এই জনপদ ছিল সমৃদ্ধ।

খনন দলের এই সদস্য জানান, এবার খননে সেখানে পোড়ামাটির গুটিকা, মৃৎপাত্র, নকশা করা ইটসহ আরও অন্যান্য নিদর্শন মিলেছে। খনন কাজ এখন শেষ পর্যায়ে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে খননস্থলগুলো সংরক্ষণের জন্য মাটি ভরাট করে রাখা হবে।