‘বেঙ্গল ডেল্টা কনফারেন্স ২০২৫’ এর প্রথম দিন

২৯ আগস্ট (শুক্রবার) ২০২৫ খ্রি: শেষ হয়েছে দুই দিন ব্যাপী ‘বেঙ্গল ডেল্টা কনফারেন্স ২০২৫’ এর প্রথম দিন। ঢাকাভিত্তিক থিংক ট্যাংক ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স (দায়রা)-এর উদ্যোগে আয়োজিত কনফারেন্সের এ আসরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাংলাদেশ অ্যাট ক্রস রোডস: রিথিংকিং পলিটিক্স, ইকোনমিক্স, জিওপলিটিকাল স্ট্র্যাটেজি’।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গ্র্যান্ড বলরুমে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয়। জুলাই শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। উদ্বোধনী অধিবেশন পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেহরিন আমিন ভুঁইয়া। এসময় দায়রার পক্ষ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক ড. মুশতাক খান। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ এবং বিপরীতে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সেই সকল তরুণদের কর্মোদ্যম তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করার সময় তিনি দায়রার উদ্যোগকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই অভ্যুত্থানের তাৎপর্য তুলে ধরেন। বিশেষ অতিথি হিশেবে উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ড. মাজলি বিন মালিক, নেপালের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী দীপক গ্যাওয়ালি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের দুজন প্রখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব- ভারতের ইন্টারনেট ভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য ওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারতরাজন এবং বাংলাদেশের ইংরেজি গণমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
সকাল ১০ঃ৫০ মিনিটে “দ্য বেঙ্গল ডেল্টা’স রিভারিন ল্যান্ডস্কেপঃ দ্য জুলাই রেভ্যুলুশন এন্ড রিকন্সট্রাক্টিং পলিটিকাল অর্ডার” শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় কী-নোট বক্তব্য পেশ করেন ড. ইফতেখার ইকবাল, সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি ব্রুনাই, দারুসসালাম। তিনি বাংলার জনজীবনের পরিচয় নির্মাণ ও বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে বাংলার ঐতিহাসিক সংযোগ নিয়ে আলোচনা করেন। অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কিউং হি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলেক্স তায়েক গোয়াং লি। তিনি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার রাজনৈতিক দর্শনের ভঙ্গুরতা তুলে ধরে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা যা কিছুর উপর ভরসা করেছিলাম, তা এখন ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। প্যানেল ডিসকাশনে আলোচক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন ড. ইরফান আহমেদ, অধ্যাপক, ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটি, তুর্কি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডক্টর পারভীন হাসান, উপাচার্য, সেন্ট্রাল উইমেন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
দুপুর বারোটায় অনুষ্ঠিত হয় “ইকনমিক স্ট্রাটেজিস এন্ড পলিটিকাল সেটেলম্যান্টসঃ আওয়ার কারেন্ট ইকনমিক চ্যালেঞ্জেস আন্ড ওয়েজ ফরওয়ার্ড” শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জাকির হোসাইন, প্রধান নির্বাহী, চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। কী-নোট বক্তব্য উপস্থাপন করেন সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক ডক্টর মুশতাক খান। তিনি বলেন, “আমাদেরকে অবশ্যই অর্থনৈতিক কৌশলের গতিপ্রবাহ পরিবর্তন করতে হবে”। প্যানেলে আলোচক হিসেবে আরো অংশ নেন অর্থনিতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্যাহ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন চ্যাম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের চেয়ারপার্সন নুরিয়া লোপেজ এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর সেলিম রায়হান।
বিকাল ২ঃ৩০ এ “রিফর্ম এন্ড রিয়েলিটিঃ বাংলাদেশ’স চেইঞ্জিং পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ” শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি সঞ্চালনা করেন ও কী-নোট আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডক্টর আসিফ সাহান, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টাল লেকচারার ডক্টর ডেভিড জ্যাকম্যান, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডক্টর তাসনিম জারা, বিএনপির চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদি আমিন। আলোচনায় ডক্টর ডেভিড জ্যাকম্যান বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ স্থিতিঅবস্থা পছন্দ করেন, আমার দৃষ্টিতে এখানে লক্ষ্য হওয়া উচিৎ স্থিতাবস্থা আনয়নের পথ সুগম করা”।
দুপুর ২ঃ১৫ তে “মিডিয়া, রিউমার, এন্ড ন্যারেটিভসঃ পোস্ট জুলাই বাংলাদেশ ইন দ্য সাউথ এশিয়ান ফ্রেইম” শীর্ষক ইন্টারেক্টিভ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন অনলাইন ভিত্তিক ভারতীয় গণমাধ্যম দি ওয়্যার এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারতরাজন এবং ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার দীপক কুমার গোস্বামী। সিদ্ধার্থ ভারতরাজন বলেন, “ভুল খবর প্রকাশ করার চেয়ে দেরিতে খবর প্রকাশ করা উত্তম”। তিনি একইসাথে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপরও জোর দেন। দীপক কুমার গোস্বামী বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম জনগণের পক্ষে কাজ করেনা, ফলে মানুষ এখন হতাশ এবং দ্বিধাগ্রস্থ।
বিকাল ৩ঃ৫৫ তে শুরু হয় “পলিসি প্রায়োরিটিজ ইন রিস্ট্রাকচারিং দ্য ইকনমিঃ ডায়াগনসিস এন্ড রিমেডিস” শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন। এই প্যানেল ডিসকাশনে কী-নোট বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর মোঃ দীন ইসলাম খান। তিনি বলেন, বানিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে সুরক্ষিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আলোচনায় আরো যুক্ত হন বিআইডিএস এর মহাপরিচালক ডক্টর এ কে এনামুল হক, লেবার রিফর্ম কমিশনের সদস্য ডক্টর অনন্যা রায়হান এবং সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ ডক্টর জয়তী রহমান। এই সেশনটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ডক্টর সায়মা হক বিদিশা।
বিকাল ৫ঃ৫৫ তে অনুষ্ঠিত হয় “জুলাই রেভ্যুলুশনঃ ক্রিটিকাল জাংচার অর এনাদার হিস্টরিকাল লুপ” শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন। এই প্যানেলে বক্তব্য রাখেন লেখক ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার। তিনি বলে্ন, “আগে আমরা রাষ্ট্রের গঠন কাঠামো ঠিক করি, তারপরে নির্বাচনে যাই, নির্বাচনিক রাজনীতি আর গাঠনিক রাজনীতির এই দুই ধারায় বাংলাদেশের শ্রেণি সংঘাত হাজির হয়েছে”। আলোচনায় আরো বক্তব্য রাখেন প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, ইউনিভার্সিটি ব্রুনেই দারুসসালামের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর ইফতেখার ইকবাল এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ আজম।
“স্টেইটলেসনেস এন্ড সভ্রেন্টিঃ অ্যা ক্রিটিকাল এনালিসিস অব সিটিজেনশীপ ডিনায়াল ইন সাউথ এশিয়া” শিরোনামে সৌম্যব্রত চৌধুরী এবং “হু ইজ মুসলিম? লিটারেরি কন্সট্রাকশন অব মুসলিম আইডেনটিটি ইন কলোনিয়াল অ্যান্ড পোস্ট কলোনিয়াল সাউদ এশিয়া’ শিরোনামে মারিয়াম ওয়াসিফ খান একক বক্তৃতা প্রদান করেন।
এছাড়া আরো তিনটি প্যানেল ডিসকাশন অনুষ্ঠিত হয়। শিরোনামগুলো যথাক্রমে, “দ্য পলিটিক্যাল ইমপ্লিকেশন্স অফ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ রিলেশনসঃ ফ্রম লিবারেশন ওয়ার টু জুলাই আপরাইজিং”, “বে অব বেঙ্গলঃ কানেক্টিভিটি, রেজিলিয়েন্স এন্ড সিকিউরিটি” এবং “হিউম্যান ক্যাপিটাল অ্যান্ড জব ক্রিয়েশন”। এই আলোচনাসমূহে দেশ-বিদেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও নীতি নির্ধারকেরা বক্তব্য রাখেন।
ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স (দায়রা) একটি ঢাকাভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক, যা বঙ্গীয় বদ্বীপে জ্ঞানের উৎপাদন ও অগ্রগতি নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির গতিশীলতাকে বোঝাপড়া চর্চায় নিবেদিত।