ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


‘মৃত’ শ্বশুরের ৫ কোটি দান,দুদকের ফাঁদে পাসপোর্টের সাবেক ডিজি


২৮ জুন ২০২১ ১১:৪১

আপডেট:
২৮ জুন ২০২১ ১১:৪৮

ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বৈধ করতে কত পন্থাই অবলম্বন করেন দুর্নীতিবাজরা। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে তারা হরহামেশাই অভিনব কৌশল নেন। কেউ কেউ পার পেয়ে যান, আবার কেউ ধরাও পড়েন। পুলিশের এমন এক সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যাংকে এককালীন স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) টাকা বৈধ করতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। টানা ১৮ বছর অনুসন্ধান আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তার আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি উন্মোচন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কমিশনের জালে ধরা পড়া ওই ব্যক্তির নাম আবদুল মাবুদ। তিনি অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। অবৈধ উপায়ে অর্জিত প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বৈধ করতে আবদুল মাবুদ জাল কাগজপত্র সৃজন করেন। জালিয়াতির এ কাজে তাকে সহায়তা করেন স্ত্রী নাসিমা খান ও শাশুড়ি সাহানারা খান।

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) আব্দুল মাবুদ খান ও তার স্ত্রী নাসিমা খানের বিরুদ্ধে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ বাদী হয়ে গত ১৬ জুন মামলাটি করেন বলে বৃহস্পতিবার জানা গেছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আব্দুল মাবুদ খান ৪ কোটি ৭২ লাখ ৩৬ হাজার ২১৬ কোটি টাকার অবৈধ উৎসকে বৈধ দেখানোর জন্য তার স্ত্রী নাসিমা খানের সঙ্গে পারস্পারিক যোগসাজশে জালজালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ও ননজুডিশিয়াল স্টাম্প ও হলফনামা সৃজন ও সম্পাদন করে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকার মিথ্যা দান ও ঋণ দেখিয়েছেন।

এ ছাড়া বৈধ উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ তথা জ্ঞাতআয়বহির্ভূত ৪ কোটি ৭২ লাখ ৩৬ হাজার ২১৬ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ৮৯৫ টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখে উত্তোলন করেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়াভাবে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও হলফনামা সৃষ্টি করে আয়ের উৎসের মিথ্যা তথ্য ও দান দেখিয়ে পাঁচ কোটি তিন লাখ তিন হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ তার অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনা করেন মাবুদ। যা দুদক আইন- ২০১৪ এর ২৭ (১) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দণ্ডবিধির ৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ...

দুদক সূত্র জানায়, ঘটনার সূত্রপাত ২০০৯ সালে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আবদুল মাবুদ সাত থেকে আটটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে বিভিন্ন ধাপে ৪৩টি এফডিআরে গচ্ছিত রাখেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত ওই টাকা বৈধ করতে নাটক সাজান মাবুদ। সেই নাটকের নানা কানাগলির রহস্য উন্মোচনে দুদকের লেগে যায় ১৮ বছর। ২০০২ সালে শুরু হওয়া অনুসন্ধানের সমাপ্তি সহসাই করতে যাচ্ছে তদন্ত সংস্থা দুদক।

আবদুল মাবুদের বক্তব্য ও আয়কর নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৩ সালে শাশুড়ি সাহানারা খানের কাছ থেকে দান হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ দেখান দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওই অর্থ বৈধ করতে জাল হলফনামা ও স্ট্যাম্প দিয়ে তৈরি করেন দানপত্র। সেখানে মাবুদ দেখিয়েছেন, সাহানারা খান তার মেয়ে অর্থাৎ আবদুল মাবুদের স্ত্রী নাসিমা খানকে ওই টাকা দান করেছেন। যা পরবর্তীতে সুদ ও আসলসহ প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা স্ত্রীর কাছ থেকে দানসূত্রে গ্রহণ করেন আবদুল মাবুদ। এক্ষেত্রে যে হলফনামা ও স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছে তা জাল বলে ইতোমধ্যে দুদকের কাছে প্রমাণিত হয়েছে।

জাল দানপত্রের বিষয়টি নিশ্চিতে আবদুল মাবুদের শাশুড়িকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদে সাহানারা খান দাবি করেন, তার স্বামী ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ কোটি টাকা মেয়েকে দান করেন। অথচ তার স্বামী আকরাম খান (মাবুদের শ্বশুর) ১৯৮৩ সালে মারা যান। কিন্তু কাগজপত্রে আবদুল মাবুদ দেখিয়েছেন, ২০০৩ সালে সাহানারা খান (শাশুড়ি) ওই অর্থ দান করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গত ২০ বছর ধরে ওই টাকা কোথায় ছিল, কীভাবে ওই টাকা আসল— এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি সাহানারা খান।

দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, জাল হলফনামা ও জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার করে আবদুল মাবুদ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে করা এফডিআর বৈধ করতেই এমন মিথ্যা নাটকের আশ্রয় নেন। এ প্রক্রিয়ায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দানসূত্রে মালিক হয়েছেন দেখিয়ে আয়কর রিটার্নেও প্রদর্শন করেন তিনি।

দুর্নীতির এমন ঘটনায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ দুদক আইনের ২৭ (১) ধারায় মামলা করেছেন। এছাড়া পুলিশের সাবেক এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামে আরও সম্পদের তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। যে কারণে শিগগিরই তার বিরুদ্ধে সম্পদের নোটিশ ইস্যু করা হতে পারেও বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বৈধ করার উদ্দেশ্যে তার স্ত্রী নাসিমা খানের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ওই উদ্দেশ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়াভাবে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও হলফনামা সৃষ্টি করে আয়ের উৎসের মিথ্যা তথ্য ও দান দেখিয়ে পাঁচ কোটি তিন লাখ তিন হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ তার অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনা করেন মাবুদ। যা দুদক আইন- ২০১৪ এর ২৭ (১) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দণ্ডবিধির ৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসের প্রথম ব্যাচের কর্মকর্তা মাবুদ অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। ২০০৯ সালে পাসপোর্টের ডিজির দায়িত্ব নিয়ে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি অবসরে যান।মাবুদের বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের কন্দর্পপুর গ্রামে। অবসরের পর তিনি একটি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পাসপোর্টের ডিজি হিসেবে যোগ দেয়ার আগে মাবুদ ও তার স্ত্রী নাসিমার নামে চারটি ব্যাংক হিসাব ছিল। ২০০৯ সালে ডিজি হওয়ার পর থেকেই তাদের নামে আরও ব্যাংকে হিসাব খোলা শুরু হয়। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায়ই তাদের ১৬টি এফডিআর বা স্থায়ী আমানতের সন্ধান পান গোয়েন্দারা।