ঢাকা বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৯শে ফাল্গুন ১৪৩১


বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব একটি জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা


৮ মার্চ ২০২৫ ২০:৫১

আপডেট:
৮ মার্চ ২০২৫ ২০:৫১

প্রাচীন স্পাটার একটা গানের কথা ছিল- "তোমরা যা আমরা তাই, তোমরা যা ছিলে আমরা তাই হবো"।
একটা সভ্যতার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য নিয়ে একসাথে জাতি গঠন করার প্রয়াস এবং সেই জাতির ভবিষ্যত ও সার্বভৌমত্বের জন্য রাষ্ট্র। 

আহমদ ছফা চট্টগ্রাম থেকে উঠে এসেছেন।আহমদ ছফার গুরু ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক । তিনি কখনো কোনো বই লেখেননি। তিন যা জানতেন যা বুঝতেন সব তিনি কেবল বলতেন। মানুষ তার কাছে গিয়ে তা শুনতো। কাজী মোতাহের হোসেন চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আহমদ ছফার মতো লেখক, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক,বুদ্ধিজীবী এমনকি মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রীগণ সবাই তাঁর বাড়িতে এসে তাঁর কথা শুনতেন, জানতেন, শিখতেন। অধ্যাপক  আব্দুর রাজ্জাককে তুলনার করা হয় দার্শনিক ডায়োজিনিসের সাথে। যদিও জ্ঞানে কখনো কারো সাথে কারোর তুলনা হয় না। জ্ঞান সবসময় বৈচিত্র্য ও ভিন্ন চিন্তার জন্ম দেয়। বাংলাদেশে মুসলিম সমাজে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা শুরুই হয়েছে বেশিদিন হয়নি।। বাংলার রেনেসাঁস বলতে আঠারশো শতকে বুদ্ধিভিত্তিক যে বিপ্লবটা হয়েছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিভূতিভূষণ , বিবেকানন্দ  প্রমুখের হাত ধরে তৎকালীন হিন্দুসমাজে। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র   ক্ষীতমোহন রায়ের হাত ধরে এগিয়ে গেছে এই চর্চা। তখনও বাঙালি মুসলমানরা ধর্মের দোহাই দিয়ে শিক্ষা থেকে দূরে ছিল। আমরা উন্নত বিশ্ব থেকে অনেক দূরে কারণ আমরা তাদের ১৫০ বছর পরে আধুনিকতা পেয়েছি। পশ্চিমারা যখন থেকে দর্শন চর্চা শুরু করেছে, যখন তাদের সভ্যতা নগররাষ্ট্রে পরিণত হওয়া শুরু হয়েছে তখন আমরা কেবল অন্যদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হচ্ছিলাম। বিভিন্ন সময়ে ইরান, তুরস্ক, আফগান, মঙ্গোল থেকে শাসক আমাদের শাসন করেছে। পশ্চিমারা প্রাচ্যে তাকালে বিশৃঙ্খল একটা জনগোষ্ঠী দেখতে পায়। আধুনিকতা পশ্চিমারা প্রাচ্য থেকে দেড় দুশো বছর আগে পেয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কলোনিয়াল শাসন করে গেছে। কারণ তাদের জ্ঞান চর্চার শুরুটা পুরনো। জ্ঞান চর্চার শুরুতে পশ্চিমের দার্শনিক, বিজ্ঞানীদেরও সময়ে সময়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু ষোলশো শতাব্দীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁস হওয়ার খুব দ্রুত সময়ে তাদের সমৃদ্ধি ঘটেছে। প্রশ্ন করা, সন্দেহ করা, উত্তর খোঁজা, বৃহৎ চিন্তা করার জায়গায় একধাপ এগিয়ে ছিল পশ্চিম। এরপর বাংলায় রেনেসাঁস আসলেও তা ছিল খন্ডিত।

আমাদের উন্নত চিন্তারা এখনো ভীষণ সংকীর্ণ। আমরা এখনো নিয়মতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, শৃঙ্খল একটা জাতি হতে পারিনি। আমরা কীভাবে রাষ্ট্র সাজাবো? আমাদের পদে পদে অজ্ঞতা। অজ্ঞতা পার করতে পদে পদে বাঁধা। আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিবাদী কার্যক্রম কম ফলে অস্ত্রের কারখানা সব পশ্চিমে আমরা কেবল চা শ্রমিক, দিনমজুর, পোশাক শ্রমিক, রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমরা পশ্চিম থেকে অস্ত্র কিনি রেমিট্যান্সের টাকায় কিন্তু সেই টাকা দুর্নীতি মুক্ত ভাবে শিক্ষাখাতে খরচ করে জ্ঞান বিজ্ঞানে স্বাবলম্বী হতে পারি না। আমাদের গবেষণা খাত এতটাই সংকীর্ণ, এই পথে বাংলার মুসলিম রেনেসাঁস এসে এখনো পৌঁছয়নি। পশ্চিমে এখন চলছে উত্তোরাধুনিকতা আর আমরা এখনো আধুনিকতায় পড়ে আছি। গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ বেশিরভাগ মানুষ মেনে নিয়েছে, কেউ বাঁধ্য হয়ে, কেউ পরিস্থিতির স্বীকার তো কেউ কেউ জানে না কী হচ্ছে,  কি করছে! তাছাড়া কেউ চায় খিলাফত, কেউ চায় সমাজতন্ত্র। ভিন্ন মত থাকতে পারে। চিন্তার বৈচিত্র্য জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে, জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কী আদৌও একটা জাতি গঠন করতে পেরেছি?

জাতি ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে? নির্দিষ্ট একটা ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতি হয় না। একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে কেন্দ্র করে জাতি গঠিত হয় না। জাতি কোনো রাজার শাসনে গড়ে ওঠে না। জাতি গড়ে ওঠে পূর্বপুরুষদের ইতিহাস,  ঐতিহ্য ও গৌরবে এবং একসাথে থাকার একটা আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। জাতি কোনো বস্তুবাচক বিষয় না। এটি ভাববাচক বিষয়। বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন গোষ্ঠীর, বিভিন্ন মানুষের একসাথে থাকার যদি ইতিহাস থাকে এবং ভবিষ্যতেও একসাথে থাকার আকাঙ্ক্ষা থাকে তবেই একটি সভ্য জাতি গড়ে ওঠা সম্ভব। ইউরোপীয় কলোনিয়াল থেকে মুক্তি আসে তাও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তবে একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, বাঙালি জাতির নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে সাথে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ভেঙে গেল।  তবে এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই নানান সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে সময়ে সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা থেকে এবং ভারতীয় লেখকদের থেকে চিন্তা আমদানি করেছে।  

ইউরোপীয়ানরা জ্ঞান চর্চা করে নিজেদের জন্য রাষ্ট্র বানিয়েছে। এর জন্য নানান সংঘাত সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তারপর তারা একই সীমারেখায় আসতে পেরেছে। আমরা যেহেতু একশো বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি, জ্ঞানচর্চা করছি তাহলে আমাদেরও নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মতো সমাজ ব্যবস্থা চিন্তা করতে হবে। অন্যদের থেকে ধার করা সমাজ ব্যবস্থা নয়, বরং ভিন্ন দল মতকে গ্রহণ করে একটি লক্ষ্যে আসতে হবে। তবে এর জন্য আমাদেরও নানান সংকট সংঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। জাতি গঠন করার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রে একটি নির্দিষ্ট ভাষা, ধর্ম কিংবা ব্যক্তির আধিপত্য না রেখে একসাথে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষরা এর থেকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েও সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল তাই আমাদের একসাথে থাকার ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরা। আমরা চাইলে একটি জাতি গঠন করতে পারি তবে এর জন্য দরকার একটি বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব।

আমির হোসেন রাজু

শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।