ঢাকা বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৯শে ফাল্গুন ১৪৩১


আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব নিরোধ ও প্রাসঙ্গিক কথা


২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩০

আপডেট:
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩১

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুশাসন, সাম্য, ন্যায়বিচার এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদার আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আদর্শ আমলাতান্ত্রিক সিস্টেম প্রতিষ্ঠার কোনও বিকল্প নাই। ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রশাসনের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোর মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, আদর্শ আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং কর্তৃত্বের বৈধতা (Legal-Rational Authority) এবং যোগ্যতা ও মেধার (Meritocracy) ভিত্তিতে নিয়োগ এবং পদোন্নতি প্রদান করা। জুলাই বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের সংস্কারের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে ‘লিগ্যাল-রেশনাল অথরিটি’ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও দক্ষ প্রশাসন পরিচালনার নির্দিষ্ট আইনের একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা অর্জনের পর পদায়ন করতে হবে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এক সদস্যের সংস্কার নিয়ে একটি মন্তব্যের পর সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একটি তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। যার একটি হল উপসচিব পদে ৫০-৫০ ভাগ এবং অপরটি হল সাধারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে আলাদা করা।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের প্রশাসনিক আইনি কাঠামোতে উপসচিব ও তার উপরের পদগুলো সবসময় প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের এবং এই পদমর্যাদার দায়িত্বগুলো তারা পালন করে আসছে। একইভাবে অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যরা তাদের পদ অনুযায়ী কাজ করে আসছেন। অন্যান্য ক্যাডার সদস্যদের এই পদে ৫০% অনাহুত প্রবেশ করালে প্রশাসনিক কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। প্রথমত, প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা নিয়োগের পর তাদের কাজের ধরন অনুযায়ী পলিসি তৈরি, নেতৃত্বের ধরনসহ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে মাঠ পর্যায়ে পাঠানো হয় এবং সাধারণ জনগণের সাথে মিশে সরাসরি কাজ করে। সহকারী কমিশনার (ল্যান্ড), উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে কাজ করার সময় স্থানীয় সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করে মন্ত্রণালয়ে এসে নীতি নির্ধারণে প্রয়োগ করে। অনভিজ্ঞ অন্য কেউ এখানে আসলে একটা বিশৃঙ্খল কাঠামো তৈরি হবে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, অবিভক্ত ভারতে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এবং পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় এবং প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থায় সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান (সিএসপি) ও ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস) এর কর্মকর্তারা প্রশাসনের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর সিএসপি, আইসিএস ও ইপিসিএস এর সদস্যদের নিয়ে স্বাধীন দেশের সিভিল প্রশাসনের যাত্রা শুরু হয় এবং এখানেও সিভিল প্রশাসনের উচ্চ পদে প্রশাসনের লোকেরাই দায়িত্ব পালন করতেন। ঐসময়ে সিভিল প্রশাসনে অন্য কোন সার্ভিসের কোন পদই ছিল না অর্থাৎ ১০০% প্রশাসনের পদ ছিল। বিসিএস কম্পোজিশন এন্ড ক্যাডার রুলস, ১৯৮০ এর মাধ্যমে প্রাক্তন সিএসপি, ইপিসিএস এবং অন্যান্য সার্ভিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে বিসিএস (প্রশাসন) এর যাত্রা শুরু হয়।

পরবর্তীতে সচিবালয়ের সুপিরিয়র প্রশাসনিক পদসমূহে অন্য সার্ভিসের সুযোগ দেওয়ার জন্য ১৯৭৯ সালে দা সুপিরিয়র সার্ভিস পুল অর্ডার, ১৯৭৯ জারি করা হয় এবং ১৯৮৯ সালে উপসচিবদের ৩৭৭টি পদের মধ্যে অন্যায্যভাবে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ৭৫টি পদ সংরক্ষণ করা হয় (প্রথম কোটা অন্তর্ভুক্ত করা)। ১৯৯২ সালে সরকারের এক আদেশে সচিবালয় ক্যাডারকে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে একত্রিত করা হয়। পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে অন্যায্যভাবে ২৫% উপসচিব পদে অন্য ক্যাডারের সদস্যদের জন্য কোটাভুক্ত করে যা ২০২৪ এর জুলাই গণ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ২.০ বৈষম্য বিরোধী সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়, ১৯৯৮ ও ২০০২ সালের পদোন্নতি নীতিমালায় প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫% পদকে অন্যান্য ক্যাডারের কয়েকজন উপসচিব প্রত্যাশী কর্মকর্তা কর্তৃক আদালতে আপিল করে। Civil Appeal No 294-98/2003 মামলার বিস্তারিত শুনানি করে ৭৫% শুধু বৈধই নয় বরং যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত এবং সংবিধান সম্মত বলে ঘোষণা দেয়। মামলার রায়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন- ‘যেহেতু পিএসসি এর সুপারিশ পর্যায় হইতে কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন ক্যাডারে শ্রেণীভুক্ত হইয়া যায় সেই হেতু সচিবালয়ের প্রশাসনিক উপসচিব পদে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ব্যতিরেকে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের পুনরায় নিয়োগ বা পদোন্নতি প্রাপ্ত হইবার কোন সহজাত অধিকার নাই’। উক্ত রায়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ, ২০২৪ এর তফসিল ৬(১) নং এন্ট্রিতে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতিযোগ্য পদ হিসেবে উপসচিব পদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তাছাড়া বিদ্যমান পদোন্নতি ও পদায়ন সংক্রান্ত নীতিমালায় অন্য ক্যাডার থেকে ডিএস পুলে আসা উপসচিবদের পদায়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা বিধান নেই। দীর্ঘদিন যে সেক্টরে কাজ করেছে সে সেক্টরে বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তাকে পদায়ন করা হলেও অনেক সময় ভালো মন্ত্রণালয়ে পদায়নের জন্য তদবির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ধরুন একজন ডাক্তার ২০ বছর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে ডাক্তার হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর ডিএস পুলে উপসচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যদি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদায়িত হয় তখন তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনের কতটুকু অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন?

বিশ্বের কোথাও বাংলাদেশের মতো সিভিল প্রশাসনে অন্যান্য টেকনিক্যাল সার্ভিসের জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা লক্ষণ করা যায় না। সিভিল প্রশাসনের স্বতন্ত্র ও গুরুত্ব নজরে নিয়ে যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদার কর্মচারীর সমন্বয়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এবং আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব নিরসনে বাংলাদেশের জন্য আলাদা এবং স্বতন্ত্র ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রকৌশল ক্যাডারদের নিয়ে বাংলাদেশ প্রফেশনাল সার্ভিস গঠন করা যেতে পারে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার সার্ভিস গঠন করা যেতে পারে। ট্যাক্স, কাস্টম, অডিট ও বাণিজ্যিক ক্যাডার নিয়ে বাংলাদেশের রেভিনিউ সার্ভিস গঠন করা যেতে পারে। প্রতিবছর পিএসসি পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওই বছরে তাদেরকে নিয়োগ প্রদান করবে। নিয়োগের পর সবাই উচ্চ প্রশিক্ষণের পর জনগণের সেবায় মনোনিবেশ করবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর যোগ্যতা অর্জন অনুযায়ী সবারই পদোন্নতি প্রদান করতে হবে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয় সেই বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ তৈরি করতে বৈষম্যহীন কর্মচারীর প্রয়োজন।