ঢাকা বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৯শে ফাল্গুন ১৪৩১


চা শ্রমিকদের নিশ্চুপ কান্নার সমাধান চাই


১৭ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৩৬

আপডেট:
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৫৩

চা বাঙালি জীবনে এক অনবদ্য বিষয়। যা আসে দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল অঞ্চল থেকে। এসকল অঞ্চলের নাম শুনলে আমাদের সামনে ভেসে উঠে চা বাগানের কাজ করা শ্রমিকদের ছবি ও মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা। আজ দেশের চা শিল্পের এই উন্নতির মূল কারিগর এই বাগানে কর্মরত চা শ্রমিকেরা। চা শিল্পে চা শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম এবং এই শিল্পের মেরুদণ্ড হিসেবে তারা পরিচিত। তাদের কঠোর পরিশ্রম ও নিবেদন ছাড়া এই শিল্পের অগ্রগতি সম্ভব ছিল না। তবে চা শ্রমিকরা কি ভালো আছে? সহজ উত্তর না নেই।

 

প্রায়শই তাঁদের নির্বাক আত্মচিৎকারের গল্প উঠে আসে বিভিন্ন মাধ্যমে। চা শ্রমিকদের শুধু ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল লাগলেও বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো। দেশের চা শিল্পের উন্নতি হলেও উন্নতি হয়নি শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের ন্যায্য মজুরি। দেশের চা শ্রমিকরা দীর্ঘদিন যাবৎ শ্রম অধিকার, মজুরি এবং জীবনযাত্রার মান নিয়ে নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। মূলত সিলেট ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন চা বাগানে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে জাতিগত সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। চা শ্রমিকদের একটি সিংহভাগ অংশ বংশপরম্পরায় চা বাগানে কাজ করে আসছেন এবং অনেক শ্রমিক বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের মানসিক নির্যাতন করা হয় । এর ভিতর অন্যতম হচ্ছে নিম্ন মজুরি ও জীবনমান।

 

২০২৪ সালে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৭৮ টাকা মাত্র। এই স্বল্প মজুরি দিয়ে  চা শ্রমিকেরা নিজের ও তাদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলস্বরূপ চা শ্রমিকদের একটি সিংহ ভাগ অংশ দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক কষ্টে জর্জরিত থাকে। চা বাগানে কর্মরত বেশিরভাগ চা শ্রমিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে কিন্তু চা বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ থেকে এসকল বিষয়ের প্রতি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে না ফলস্বরূপ স্বাস্থ্য সেবার অভাবে প্রায়শই শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটে। এত স্বল্প মজুরির কারণে শ্রমিকেরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে ব্যর্থ হচ্ছে যার দরুন সে সকল শিক্ষার্থীদের চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়। গণমাধ্যমে কষ্ট করে মায়ের কাজের টাকায় ঢাবিতে ভর্তি হয়েছেন ছেলে, এমন সংবাদ আমরা পেয়েছি। অভাবের তাড়নায় প্রায়ই চা শ্রমিকরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চা শ্রমিকদের বসবাসের জন্য বাগানে প্রদান করা হয় কুঁড়েঘর। যে ঘরে থাকে না তেমন কোনো সুযোগ সুবিধা তবে রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। প্রতিটি চা শ্রমিকের উপর থাকে এক স্নায়ুচাপ কারণ প্রতিদিন একজন চা শ্রমিককে ২০ কেজি করে চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়। ২০ কেজি চা পাতার কম সংগ্রহ করলে যত কেজি কম সংগ্রহ করা হয়েছে তা কেজি প্রতি ৬ টাকা করে মোট মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হয় কিন্তু ২০ কেজির উপরে সংগ্রহ করলে চা শ্রমিককে অতিরিক্ত সংগৃহীত প্রতি কেজি বাবদ ২ টাকা করে দেওয়া হয়। এসকল বৈষম্য ছাড়াও চা শ্রমিকদের সাথে ঘটে নানান ধরনের বৈষম্য, এছাড়াও নারী চা শ্রমিকদের জীবন অতিবাহিত হয় বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। চা বাগানে কাজের বিনিময়ে যে অর্থ শ্রমিকেরা উপার্জন করে তা নিতান্ত যৎসামান্য থাকায় বেশির ভাগ চা শ্রমিক অংশ নিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।

 

এসকল বৈষম্য, বঞ্চনা সহ অন্যান্য অসুবিধা গুলোর জন্য এখন প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান। যেই সমাধান হতদরিদ্র চা শ্রমিকদের জীবনে এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সর্বপ্রথম ন্যায্য ও বৈষম্যহীন মজুরি ব্যবস্থার প্রচলন শুরু করতে হবে। যা নির্ধারণ করা কবে চা শ্রমিকের কাজের পরিধি বিবেচনায়। চা বাগানে বসবাসরত শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারকে চা বাগান  সংলগ্ন এলাকা সমূহতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চা শ্রমিকদের জন্য দেওয়া আবাসস্থলের যথাযথ মান উন্নয়ন করতে হবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। চা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যেন যেকোনো অসুবিধায় চা শ্রমিকেরা সহায়তা পেতে পারে৷ ট্রেড ইউনিয়নকে যথাযথ স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে যেন তারা চা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে পারে। উক্ত এসকল উদ্যোগ যথাযথ ভাবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে চা শ্রমিকদের জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং তাদের জীবন মান উন্নত হবে।

 

লেখক-

মাইনুল ইসলাম অমি

লোকপ্রশাসন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

কার্যনির্বাহী সদস্য

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিচার, কলাম ও কন্টেন্ট রাইটার্স।


opinion