ঢাকা বুধবার, ১৪ই মে ২০২৫, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


অবৈধ পন্থায় আয়ের অর্থে প্রকৌশলী খায়রুল বাশার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গড়েন কোটি কোটি টাকার সম্পদ

স্ত্রী ও মায়ের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা


১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:০২

আপডেট:
১৪ মে ২০২৫ ১৪:০৩

প্রকৌশলী থেকে নাম উঠে ঠিকাদারিতে। গড়ে তোলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়ে ও ঘুষগ্রহণ থেকে কোটি কোটি টাকা আয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে নামে- বেনামে সম্পদ। মালয়েশিয়াতেও গড়েছেন সেকেন্ড হোম। তিনি ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশার।

একাধিকবার বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওয়াসার এই প্রকৌশলীর নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টেবিলে। ১৯৯৭ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা ওয়াসায় নিয়োগ পান খায়রুল বাশার। বর্তমানে তিনি ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী।

ওয়াসায় প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের একজন তিনি। ক্ষমতার দাপটে অধীনস্থদের সঙ্গেও খারাপ আচরণের অভিযোগ প্রায়শই ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওয়াসার অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেও এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজমান। খায়রুল বাশারের অবৈধ টাকার মেশিন স্ত্রী ও মায়ের নামে গড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রকৌশলী স্ত্রী ঊর্মি ও মা বিলকিস আহমেদের নামে খোলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক কনসোর্টিয়াম।

অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালে সর্বনিম্ন দরদাতা না হয়েও ৮টি পানির পাম্পের জন্য ২টি গ্যাস জেনারেটর সরবরাহের নামে ১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় ম্যাক কনসোর্টিয়াম। এছাড়াও বিভিন্ন আকৃতির মিটার ক্রয়ের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

জানা যায়, যেখানে একেকটি মিটার এক লাখ টাকা সেখানে তিন লাখ টাকায় সরবরাহ করে ম্যাক কনসোর্টিয়াম। ওয়াসায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করে খায়রুল বাশারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ড্রেনেজ বিভাগের জন্য ২৫ কিউসেকের পানির পাম্প সরবরাহের নামেও কোটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পানির পাম্প স্থাপন ও সরবরাহে অন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তোলে কয়েকগুণ দাম নিয়ে নেয় ম্যাক কনসোর্টিয়াম।

এখানেই শেষ নয়, খায়রুল বাশারের গড়া প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে ম্যানহোলের জন্য নিম্নমানের প্লাস্টিকের ঢাকনা সরবরাহ করেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, কাজী খায়রুল বাশার ঠিকমতো অফিসে সময় দেন না।

নিজের ঠিকাদারির জন্য বেশির ভাগ সময়ই অফিসের বাইরে থাকেন। বিষয়টি ওয়াসা কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। খায়রুল বাশার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঊর্ধ্বতন ও অধঃস্তনদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। যেটা সরকারি চাকরির শৃঙ্খলাবিধির পরিপন্থি। চাকরি বিধি লঙ্ঘনের অপরাধে ২০১৭ সালের ৩০শে জুলাই খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

এর আগে ২০১৬ সালের ১৯শে অক্টোবর এই নির্বাহী প্রকৌশলীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন- ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পের পরিচালক একেএম সহিদ উদ্দিন একটি এইচডিডি মেশিন বিনা অনুমতিতে গ্রহণ করার পত্র ইস্যু করার বিষয়ে জিজ্ঞাস করেন খায়রুল বাশারের কাছে। এ সময় প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন ও ফাইল ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করেন।

পাশাপাশি সহিদ উদ্দিনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেন খায়রুল বাশার। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ মামলা করে তার বিরুদ্ধে। ওয়াসায় খায়রুল বাশারের কেলেঙ্কারির শেষ নেই। দু’বছর আগে ঢাকা এনভায়রনমেন্ট সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্টেও বিশাল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তিনি প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যান্যদের মতামত না নিয়ে অবজারভেশন নথি তৈরি করেন।

ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অন্য ঠিকাদারদের হাতে প্রজেক্টের গোপন নথি তুলে দেন বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে।

এসব অনিয়মের অভিযোগ ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে খায়রুল বাশারকে চিঠি দেয়া হয়। একই সঙ্গে দশদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়া হয় তাকে। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা করেননি। জানা যায়, ওই প্রকল্পে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গোপনে টেন্ডার নথি তুলে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ৪০ শতাংশ করে লভ্যাংশ নেন খায়রুল বাশার। এসব অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এই নির্বাহী প্রকৌশলী। তবে এবারও ওয়াসা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

সব অভিযোগ আমলে নিয়ে ২০১৮ সালে খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা এবং ওএসডি করে ওয়াসা। তবে তিনি প্রতিবারই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির এমডি বরাবর চিঠি দিয়েছেন। অবৈধ পন্থায় আয়ের অর্থে প্রকৌশলী খায়রুল বাশার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গড়েন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সূত্র জানায়, ঠিকাদারির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে প্রথমেই ঢাকার উত্তরার ১৩ নং সেক্টেরের ২০ নং রোডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি।

স্ত্রী ঊর্মির নামেও রয়েছে তিনটি প্লট। আরও জানা যায়, ঢাকার নাখালপাড়ায় একটি বাড়ি ও মিরপুরেও রয়েছে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এছাড়া ঢাকার অদূরে আশুলিয়াতে খায়রুল বাশারের ২২ কাঠা পরিমাণ একটি প্লট রয়েছে। অন্যদিকে গাজীপুরের শ্রীপুর মাওনা চৌরাস্তার মূল সড়কের পাশে ১৪ বিঘা জমি ক্রয় করেন তিনি।

সেখানে মাছের ঘের ও বাগান বাড়ি রয়েছে। এছাড়া নিজের এলাকা খুলনার সোনাডাঙা এলাকায়ও রয়েছে একাধিক জমি। এসব সম্পদ ওয়াসায় চাকরি নেয়ার পর হয়েছে খায়রুল বাশারের। শুধু দেশেই নয়। দেশের বাইরে মালয়েশিয়াতেও রয়েছে খায়রুল বাশারের সেকেন্ড হোম। দেশে বিভিন্ন নামে-বেনামে ব্যাংক হিসাবে টাকা থাকার পাশাপাশি বিদেশেও অর্থ পাচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে খায়রুল বাশারের সঙ্গে কথা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাদের কথা বলা নিষেধ রয়েছে। তিনি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এ ব্যাপারে 

বলেন, তার বিরুদ্ধে একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছি। যেহেতু প্রতিবেদন পাইনি তাই এখনই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। ওদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হওয়ার পর তার অনুসন্ধানের প্রস্তুতি চলছে। অনুসন্ধানের পরই তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।