ঢাকা শুক্রবার, ১৬ই মে ২০২৫, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


মোহাম্মদপুরের রাজীব সলু রতন গ্রেপ্তার আতঙ্কে, খুজঁছে পুলিশ


১৬ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:০৪

আপডেট:
১৬ মে ২০২৫ ০৫:০৪

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে ফ্রিডম মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার পর মোহাম্মদপুর এলাকার অবৈধ দখল ও চাঁদাবাজিতে জড়িত অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ এলাকায় থাকলেও আছেন গ্রেপ্তারের ভয়ে। তাদের ধরতে ইতিমধ্যে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং ছাড়াও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এলাকায় খোঁজখবর অব্যাহত রেখেছেন।

ছোট কয়েকটি অভিযানও চালিয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা তারেকুজ্জামান রাজীব, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু, বর্তমান কাউন্সিলর নূরুল ইসলাম রতন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা চাঁন মিয়া, আক্কাস হাজি, আলা বকস, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তুহিন, যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা কামরান প্রিন্স মহব্বতসহ প্রায় এক ডজন নেতার বিরুদ্ধে অবৈধ দখল, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।

অনেক আগে থেকেই অবৈধ দখলদার হিসেবে চাঁন মিয়া, সলিমুল্লাহ সলু, আলা বকস, আক্কাস হাজির কুখ্যাতি ছিল। তাদের পর এখন মিজান, রাজীব, রতন ও তুহিনের বাহিনী বেপরোয়া। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এলাকায় এসব ব্যক্তিকে খুব একটা দেখা যায় না। তারা অনেকেই গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে আছেন বলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর এলাকার আওয়ামী লীগ-যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কাউন্সিলর রাজীবের বাড়ি ভোলায়। তার বাবা তোতা মিয়া ও চাচা ইয়াসিন মিয়া মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রাজীব ছিলেন টং দোকানদার। একটা সময় তিনি যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন। এ সময় তিনি কয়েক তরুণের সমন্বয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় মোটরসাইকেল বাহিনী গড়ে তোলেন। সাবেক একজন প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে তিনি ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পান। জবরদস্তি করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বজলুর রহমানকে পরাজিত করে কাউন্সিলর হন। এরপরই দ্রুত ‘ভাগ্য বদল’ হয় রাজীবের। চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হন রাজীব ও তার পরিবারের লোকজন। তার দখল ও চাঁদাবাজিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন যুবলীগ নেতা শাহ আলম জীবন, ‘সিএনজি কামাল’, আশিকুজ্জামান রনি, ফারুক ও রাজীবের শ্যালক ইমতিহান হোসেন ইমতিসহ অনেকে।

স্থানীয়রা জানায়, কাউন্সিলর হওয়ার পর রাজীবের লোকজন মুক্তিযোদ্ধা পাইন আহমেদকে মারধর করে। ওই ঘটনায় রাজীবকে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ওই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। কাউন্সিলর হওয়ার আগে মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের শাহাদাত হোসেনের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন রাজীব। এখন ওই বাড়ির পাশেই বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন তিনি। যে জমিতে বাড়িটি করেছেন, ওই জমির মালিক ছিলেন বারী চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। স্থানীয়রা বলছেন, এই জমির কিছু অংশে পানির পাম্প বসানোর কথা বলে কৌশলে পুরোটাই দখলে নিয়েছেন রাজীব।

স্থানীয়দের দাবি, রহিম ব্যাপারী ঘাট মসজিদের কাছে আবদুল হক নামের এক ব্যক্তির ৩৫ কাঠার একটি প্লট যুবলীগের কার্যালয়ের নামে দখলে নেন রাজীব। ওই জমির পাশেই জাকির হোসেনের প্রায় আট কাঠার একটি প্লট দখলের চেষ্টা করেন তিনি। পরে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ওই জমি উদ্ধার করেন জাকির। অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশের ময়ূর ভিলার মালিক রফিক মিয়ার জমি দখল করেছেন রাজীব। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে সাত মসজিদ হাউজিংয়ে আমেরিকাপ্রবাসী নজরুল ইসলামের তিন কাঠার প্লট দখলের অভিযোগ রয়েছে রাজীবের লোকজনের নামে। এছাড়া রাজীবের সহযোগিতায় তার চাচা ইয়াসিন চাঁদ উদ্যানের ৩ নম্বর রোডে তিনটি প্লট দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ। এ নিয়ে মামলাও রয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের বাইরে চাঁদ উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, সাত মসজিদ হাউজিং, ঢাকা উদ্যানসহ বিভিন্ন প্রকল্পে রাজীব ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে দখলবাজির অভিযাগ রয়েছে। রামচন্দ্রপুর মৌজার ৫৮১ ও ৫৮২নং দাগে দুই বিঘা জমি দখল করে মার্কেট তৈরির অভিযোগও করেন স্থানীয়রা। এছাড়া কাঁটাসুর, জাফরাবাদ ও রামচন্দ্রপুর মৌজায় সুজন সখির খাল ও হাইক্কার খাল এবং জলাধার দখল করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ইকবালে রোডের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম  বলেন, রাজীবের চাচা ইয়াসিন প্রায় ২৫ কোটি টাকায় ইকবাল রোডে একটি বহুতল বাড়ি কিনেছেন। একজন রাজমিস্ত্রি এত টাকা দামের বাড়ি কেনায় এলাকায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে রাজীব তার নিজস্ব লোক দিয়ে ট্রাক স্ট্যান্ড, লেগুনা ও অটোরিকশা থেকেও চাঁদা নেন। এসব কাজের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে তার আলাদা লোক নিয়োগ করা রয়েছে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে ব্যাটারিচালিত ৮০০ রিকশা থেকে মাসে এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেয় তার লোকজন।

স্থানীয় বাসিন্দারা রাজীবের পাশাপাশি সাবেক কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলুর নামেও বিস্তর অভিযোগ করেছেন। তারা জানান, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ঘুরে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সলু ছিল একসময় সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য। তুরাগ নদ ও বেড়িবাঁধ এলাকায় নৌকা ও গাড়িতে ডাকাতি করতেন তিনি।

পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকাতেও সন্ত্রাসী হিসেবে সলুর নাম রয়েছে। হত্যা, নারী নির্যাতন, দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্র আইনসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ২৪টির বেশি মামলা আছে তার নামে।

১৯৭৮ সালে বিজলী মহল্লার একটি বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে গণপিটুনির শিকার হন সলু। পরে সামরিক আদালতে তিন বছর সাজা হয় তার। সাজা ভোগের পর রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন সলু।

ওই সময় আবুল, হাসু, ‘কাইল্যা’, কাশেমসহ কয়েকজনকে নিয়ে দখল ও চাঁদাবাজির একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। ওই বাহিনী দিয়ে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি, খাসজমি, খাল ও জলাধার দখল করে এখন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক সলু। মোহাম্মদপুর এলাকায় নামে-বেনামে তার অর্ধশত বাড়ি রয়েছে।

যার অধিকাংশই অবৈধ দখল করা। অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন সলু। বিএনপি নেতা বাবুল, ছাত্রদল নেতা সজল, ওয়ার্ড কমিশনার শাহাবুদ্দিন, যুবলীগ নেতা ইউনুস, ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি জামান খুন ও ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার রাজু হত্যা মামলার আসামি এই সলু। তবে রাজীব ও রতন বাহিনীর কারণে এখন অনেকটাই কোণঠাসা তিনি।

ঢাকা উত্তরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমানে কাউন্সিলর সলুর বড় বোনের স্বামী রতন। গত কাউন্সিলর নির্বাচনে রতনের কাছে পরাজিত হন সলু। সে থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ। এই রতনের বিরুদ্ধেও দখল, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযাগ রয়েছে। গতকাল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি দল রতনকে আটকের জন্য তার বাসা ও কার্যালয়ে হানা দেয় বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

তবে রতন বিষয়টি অস্বীকার করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি সকাল থেকেই অফিসে আছি। আমি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত নই। আমার ভয় পাওয়ারও কিছু নেই।’

মোহাম্মদপুর এলাকায় অবৈধ দখলের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আক্কাস আলী ও আলা বকসের বিরুদ্ধেও। স্থানীয়রা বলছেন, এ দুজন একসময় শ্যামলী সিনেমা হলে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করতেন। অবৈধ দখল বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা এখন শতকোটি টাকার মালিক।

আক্কাস চন্দ্রিমা হাউজিং, সিলিকন হাউজিং ও আক্কাসনগর স্থাপনের নামে বহু মানুষের জমি, খাসজমি, জলাধার ও খাল দখল করেছেন। বিশেষ করে রামচন্দ্রপুর মৌজা ও বড়বর মৌজার জলাধার এবং খাসজমি দখলের অভিযোগ রয়েছে আক্কাসের বিরুদ্ধে। তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, আক্কাস বর্তমানে নিষ্ক্রিয়।

বিদ্যুৎস্পর্শে পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য একত্রে মারা যাওয়ার পর আক্কাস নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি বাসা থেকে তেমন একটা বের হন না। তার একসময়ের সহযোগী আলা বকস এখন মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সভাপতি। তার বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজীবের দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য গতকাল দুপুরে তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে কয়েক দফায় ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এর আগে তিনি তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ থাকলে আমাদের পুলিশ আছে, গোয়েন্দা সংস্থার লোক আছে, তাদের এসব বিষয়ে জানার কথা। অভিযোগ তো সবার বিরুদ্ধে করা যায়। প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যাবে না।

আমি রাজনীতি করি, এলাকার জনপ্রতিনিধি। আমার বিরুদ্ধে এক পক্ষ বলবেই, সেটাই স্বাভাবিক। এটাকে ঠিক অভিযোগ বলা যাবে না।’ রাজীবের দাবি, বাড়ির জায়গাটি তার কেনা সম্পত্তি। তিনি কারও কোনো বাড়ি দখল করেননি। কয়েকটি হাউজিংয়ের সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা করেন। যার তথ্যও তার আয়কর বিবরণীতে দেওয়া আছে।