ঢাকা শনিবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৫, ৭ই বৈশাখ ১৪৩২


ছয় বছরে সারা দেশে ৪০,৮৮২টি ধর্ষণ মামলা

প্রতিদিন ১৯ ধর্ষণ


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৩৯

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১১:০১

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অবুঝ শিশু, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, গৃহবধূ-কেউই রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকের হাত থেকে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, অর্ধযুগে সারা দেশে ৪০ হাজার ৮৮২টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে; অর্থাৎ দিনে গড়ে ১৯টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হচ্ছে। একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার তথ্য বলছে, বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু ও কিশোরীরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধর্ষকরা যেন প্রতিরোধহীন। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং ধর্ষণ মামলার বিচারে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পরও এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনায় ফুঁসে ওঠে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সোচ্চার হয় মিডিয়া, কিছুদিন পর সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। আবার অনেক ধর্ষণের ঘটনায় কোনো কূলকিনারা পায় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অধরাই থেকে যায় আসামিরা। ফের চাঞ্চল্যকর কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সোচ্চার হয় ছাত্র-জনতা-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সবশেষ মাগুরার শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ২০১৯ সালে ৬,৭১৭টি, ২০২০ সালে ৭,৫০১টি, ২০২১ সালে ৭,৫১৮টি, ২০২২ সালে ৭,২৮৯টি, ২০২৩ সালে ৬,২৯১টি এবং ২০২৪ সালে ৫,৫৬৬টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, ছয় বছরে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ৩,০৬২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৫৭৮টি, ২০২০ সালে ৫৬৯টি, ২০২১ সালে ৫৪৬টি, ২০২২ সালে ৪৯৭টি, ২০২৩ সালে ৪৮৬টি এবং ২০২৪ সালে ৩৮৬টি।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ২২৭টি ধর্ষণের ঘটনা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ ভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না।

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ধর্ষকদের উৎসাহিত করছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানসিকভাবে বিকৃত, অসুস্থরা ধর্ষণে জড়াচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ধর্ষণ মূলত ভিকটিম ও তার পরিবারের জন্য একটা লজ্জাজনক ঘটনা। সামাজিক, আর্থিক ও ধর্মীয়-সবকিছু মিলেই প্রতিকূল অবস্থার ভেতরে ভিকটিমকে (ভুক্তভোগী) মামলা পরিচালনা করতে হয়। মাঝে টু ফিঙ্গার টেস্ট ছিল, যেটা আমরা রিট করে বাতিল করেছি। এখনো ডিএনএ টেস্ট, মেডিকেল রিপোর্ট-এসব মান্ধাতার আমলের সিস্টেম রেখে ভুক্তভোগী সঠিক বিচার পাবে না। যেমন : একজন বিবাহিত নারী যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার ক্ষেত্রে মেডিকেল রিপোর্ট দেবে সেক্সচুয়ালি হেভিচুয়েট। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যদি থাকে, তাহলে ধর্ষণ কমবে বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ৫ মার্চ রাতে মাগুরা শহরে বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আট বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১৩ মার্চ পৃথিবীকে ধিক্কার জানিয়ে চিরবিদায় নেয় শিশুটি। এর আগে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবির) এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার মুখ চেপে ধরে সড়কের পেছনে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণের পাশাপাশি নির্যাতনও করে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনুর লাশ কুমিল্লা সেনানিবাসের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। এ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তখন সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু আজও তনুর হত্যাকারীদের খুঁজে পায়নি পুলিশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ডা. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যারা এ কাজ (ধর্ষণ) করছে, তারা মানসিকভাবে বিকৃত, অসুস্থ। তাদের মানসিক ডেভেলপমেন্ট ঠিকমতো হয়নি। এছাড়া দেশে ড্রাগের (মাদক) ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এখন হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। এসব খেয়ে মানুষের মধ্যে যে এডিকশন হয়, তখন মানুষের বাছবিচারের কোনো ক্ষমতা থাকে না। এ ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘শুধু আইন দিয়ে নয়, সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করতে হবে। স্কুল-কলেজে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পরিবারিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি যে ব্যক্তি এ কাজ করছে, তার সর্বোচ্চ শাস্তি যেন পরিবারের সামনে দেওয়া হয়। তাহলে দেশে মানুষ বুঝবে আকাম করলে শাস্তি হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘ধর্ষণ প্রতিরোধযোগ্য; যদি প্রতিরোধের জন্য আইন প্রয়োগ করা হয়। একসময় অ্যাসিড-সন্ত্রাস মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সেই অ্যাসিড-সন্ত্রাস এখন নেই। তার একটাই কারণ-আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার ইচ্ছা এবং সব মানুষকে সচেতন করার ইচ্ছা।’

তিনি বলেন, আমাদের দেশের সমস্যা হচ্ছে আইন প্রচুর। কিন্তু এর থেকে বড় কথা-আইনের প্রয়োগ করতে হবে। যে আইন আছে, সেটি যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়, বিচারের ব্যবস্থা যদি সঠিকভাবে ঠিক সময়ে হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, ধর্ষককে যদি তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করা হয়, তাহলে ধর্ষণ কমানো কঠিন কোনো ব্যাপার না। যেটা দরকার সেটা হচ্ছে প্রশাসনের সদিচ্ছা, বিচারের সদিচ্ছা, বিচারকার্যের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের সদিচ্ছা। এছাড়া যে এলাকায় ধর্ষণ হবে, সেই এলাকার ইউএনও, কাউন্সিলরদের অ্যাকাউন্টেবল (দায়বদ্ধ) করতে হবে। তাহলে ধর্ষণ অনেক কমে যাবে।