কোটিপতিদের পকেটেই ব্যাংক ঋণের ৭৬ শতাংশ

২০২৪ সালে ব্যাংকের এ ধরনের গ্রাহকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ২ শতাংশেরও কম, যেখানে মোট ঋণের ৭৫ শতাংশের বেশি গেছে কোটিপতি গ্রাহকদের পকেটে। আর বাকি অংশ পেয়েছেন অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহৎ ঋণের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহকরা। অথচ দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ছোট উদ্যোক্তারাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের আমানতের হিসাব সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩২টিতে। এসব হিসাবে সম্মিলিত জমার পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানতের হিসাব সংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার ৯৩৭টি। এক বছরে আমানত হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৯৬ লাখ ৮৬ হাজার ৫৯৫টি বা ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। এক বছর আগে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা ছিল ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো, যেখানে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৮১০ জন। অর্থাৎ ১১ জনের জমা করা টাকা ভোগ করছেন মাত্র একজন। এটা ছিল সার্বিক হিসাব। এক বছর আগে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। আর ঋণগ্রহীতা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ২৭৮ জন। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর ঋণগ্রহীতা বেড়েছে ১ লাখ ৪৬৮ জন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক ঋণের বেশিরভাগই যাচ্ছে কোটিপতি গ্রাহকদের পকেটে।
এতে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের হাজারো উদ্যোক্তা। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক, মুটে, মজুর, দোকানির সাধারণত খুব বেশি ঋণের প্রয়োজন হয় না। তারা সাধারণত ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ বা ব্যবসাভেদে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। আর নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ নেন ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর বাইরে কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নেন মধ্যম আয়ের চাকরিজীবীরা, যারা বাড়ি ও গাড়ির কেনার জন্য ঋণ নিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশই নিয়েছেন মাত্র ৪ হাজার ২৬৮ জন গ্রাহক। অথচ নিম্ন আয়ের মানুষ বা লাখ টাকার নিচের ঋণগ্রহীতারা মাত্র ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন। এসব গ্রাহকের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৪৬ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ১-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া গ্রাহকদের মোট ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
৫০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে মোট ঋণের ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছেন। তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৬ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর বাইরে মধ্যম আয়ের চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী বা কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া গ্রাহকরা ৯৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এমএমই ঋণ বিশেষজ্ঞ আরফান আলী বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের ব্যাংকগুলো গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি। ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে খরচ বেশি হওয়ার অজুহাতে তারা বরাবরের মতোই এ খাত থেকে সরে আসে।
এতে গ্রামের মানুষ বেশি সুদে এমআরএ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ ব্যাংকগুলো এগিয়ে এলে কৃষক স্বল্প খরচে ঋণ নিতে পারতেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচও কমত। এ কথা ঠিক যে, গ্রামে ঋণ বিতরণে খরচ কিছুটা বেশি হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলোর তো সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণে যে ধরনের সক্ষমতা প্রয়োজন অনেক ব্যাংকেরই তা নেই। এ কারণে ব্যাংকগুলো এমএফআই প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নিয়ে ঋণ বিতরণ করে। এখন আবার কোনো কোনো ব্যাংক ফিনটেক কোম্পানিগুলোরও সহায়তা নিচ্ছে।
এর পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে ছোট ঋণ বিতরণে খরচ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলো আগ্রহ কম দেখায়। এ ছাড়া গ্রামে ব্যাংকের তেমন জনবল না থাকায় গ্রাহকের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কম। এমন পরিস্থিতিতে অপরিচিত ও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তাই ঋণ বিতরণে অনীহা দেখায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশই গেছে ৪ হাজার ২৬৮ জন গ্রাহকের পকেটে। ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া এসব গ্রহীতার মোট ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। ২০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নেওয়া গ্রাহকের সংখ্যা ১২ হাজার ৩০৬ জন।
তাদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৪৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন—এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৩৩৯ জন। তাদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংকের মোট ঋণের ৬২ দশমিক ১৪ শতাংশ রয়েছে এসব গ্রাহকের কাছে। ১ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৯৮ জন। তাদের হাতে রয়েছে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ০৩ শতাংশ, অঙ্কে যার পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকা।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, শিল্প খাতে ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড়দের খেলাপির হার বেশি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার পরও বারবার ঋণ পাচ্ছে। তাই এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। এ ছাড়া পুনঃতপশিল ও পুনর্গঠন সুবিধার কারণে এ খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণ বেশি। এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের নতুন করে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। নতুন ঋণ যাতে না বাড়ে এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ খাতে খেলাপি ঋণ কমবে।