সরেজমিন অনুসন্ধানে কর্মীশূন্য কার্যালয়ের ভিড়ে ব্যতিক্রম কিছু সক্রিয় দল দেখা গেছে
অস্তিত্বহীন দলের নিবন্ধন দৌড়

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়া নতুন ২২টি রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগের সাংগঠনিক ভিত্তিই নড়বড়ে; অনেক দলের নেই কোনো অস্তিত্ব। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ দলের ঘোষিত কেন্দ্রীয় কার্যালয় হয় অস্তিত্বহীন, নয়তো নামসর্বস্ব। কোথাও ঠিকানাই ভুয়া, আবার কোথাও কার্যালয় থাকলেও তা নেতাকর্মীশূন্য। তবে এই হতাশাজনক চিত্রের মধ্যেই কয়েকটি দলকে পাওয়া গেছে ব্যতিক্রমী রূপে, যাদের কার্যালয় সক্রিয় এবং সাংগঠনিক তৎপরতা দৃশ্যমান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছে ২২টি দল। তবে সরেজমিন অনুসন্ধানে এই দলগুলোর সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেশিরভাগ দলেরই বাস্তবে কোনো কার্যক্রম নেই, যা নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
কোথাও শুধু ব্যানার, কোথাও ঠিকানা ভুয়া
ইসিকে দেওয়া ঠিকানা ধরে দলগুলোর কার্যালয় খুঁজতে গিয়ে এক অবাক করা চিত্র উঠে এসেছে। রাজধানীর পল্টনের নুরজাহান শরীফ প্লাজায় ‘বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ’-এর কোনো অফিসের সন্ধান মেলেনি। ভবনের ব্যবস্থাপক ও অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তারা এমন কোনো দলের নাম শোনেননি বলে জানান। একইভাবে, সাভারে ‘মৌলিক বাংলা’ এবং ‘বাংলাদেশ সলুশন পার্টি’-র দেওয়া ঠিকানায় কোনো কার্যালয় বা সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উত্তরায় ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি)’-র চিত্র আরও অদ্ভুত। সেখানে একটি নির্মীয়মাণ ভবনের গায়ে কেবল একটি ব্যানার টাঙানো থাকলেও অফিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। মালিবাগে ‘নতুন বাংলাদেশ পার্টি’-র ঠিকানায় গিয়ে ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা জানান, আগে একটি রাজনৈতিক দলের অফিস থাকলেও এখন আর নেই। কলাবাগানে ‘বাংলাদেশ বেকার পার্টি’-র কার্যালয়টি মূলত দলটির সভাপতির স্ত্রীর নামে থাকা একটি আবাসিক ফ্ল্যাট, যেখানে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
অফিস আছে, কার্যক্রম নেই
কিছু দলের অফিস পাওয়া গেলেও সেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো চিহ্ন নেই। পুরানা পল্টনে ‘বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি’-র অফিসে একজন পাহারাদার ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, দলটির মহাসচিব দুবাইতে এবং আমির চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। নর্থব্রুক হল রোডে ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামী ইসলামি পার্টি’-র কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি দশ তলার ছাদে একটি তালাবদ্ধ কক্ষ মাত্র। এছাড়া তোপখানা রোডে ‘বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)’-র কার্যালয়ের দরজাও বন্ধ পাওয়া গেছে।
ব্যতিক্রম কিছু সক্রিয় দল
তবে এর ব্যতিক্রমী চিত্রও দেখা গেছে। সেগুনবাগিচায় ‘বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি)’-র কার্যালয়ে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ সংস্কার পার্টির (বিআরপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি ‘গভীর সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন।
নুরুল হক বলেন, “মব সন্ত্রাস, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই এবং চাঁদাবাজির মতো অপরাধ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং তারা আর এটি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।”
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে তিনি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। তার মতে, জনগণের ন্যায্য দাবি ও আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ সংস্কার পার্টি (বিআরপি) তাদের পাশে থাকবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করে বলেন, “প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন আয়োজন করা হলে দেশে আবারও ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে আসার ঝুঁকি রয়েছে।” সরকারের প্রতি তার আহ্বান, সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, তবে তার আগে অবশ্যই রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে, পুরানা পল্টনে ‘ভাসানী জনশক্তি পার্টি’-র কার্যালয়েও দলটির চেয়ারম্যানকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এছাড়া বাংলামোটরে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ এবং বনানীতে ‘জনতার দল’-এর সুসংগঠিত ও সক্রিয় কার্যালয় পাওয়া গেছে, যেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা অনেক দলেরই সাংগঠনিক ভিত্তি কেবল কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। এটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়া ২২টি দল:
ফরোয়ার্ড পার্টি, আম জনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), মৌলিক বাংলা, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি, জনতার দল, জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাহজাহান সিরাজ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বাংলাদেশ সলুশন পার্টি ও নতুন বাংলাদেশ পার্টি।