টার্গেট ঢাকা-১৫ ও ১৭
জগিংয়ের নামে জামায়াতের গোপন ব্রিফিং ফাঁস

ঢাকার দুটি আসনে নাশকতার টার্গেট করে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের সংগঠকরা মাঠে নেমেছে। দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক নেতাকর্মীকে রাজধানীর গুলশান, মিরপুর ও কাফরুল এলাকায় অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। ঢাকা-১৫ (মিরপুর-কাফরুল) ও ঢাকা-১৭ (গুলশান-বনানী) আসনে কেন্দ্রভিত্তিক গোপন কমিটিও করেছে জামায়াত।
এ দুটি আসনের প্রত্যেক কেন্দ্রের জন্য প্রশিক্ষিত ২০০ কর্মীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে 'লাঠি প্রশিক্ষণ'। এসব কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রাজধানীর বিভিন্ন পার্কে জগিংয়ের নামে নিজেদের মধ্যে ব্রিফিং করছেন। এভাবে নির্দেশনামূলক প্রয়োজনীয় বার্তা বিনিময় করা হচ্ছে। সম্প্রতি গুলশান থানা জামায়াতের রোকন নাজমুল হক সুমনকে গ্রেফতার করে ডিবি এসব তথ্য পেয়েছে। সুমন বনানীর বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষক।
ঢাকা-১৫ আসনে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার মিরপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামাল মজুমদারের একটি প্রচার কেন্দ্রে হামলার ঘটনা ঘটেছে। জামায়াত-শিবির এ হামলা করেছে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। ঢাকা-১৭ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন ২০ দলভুক্ত বিজিপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। আসনটিতে নৌকার প্রার্থী অভিনেতা আকবর হোসেন খান পাঠান (ফারুক)। তবে দলীয় প্রার্থী না থাকলেও জামায়াত-শিবির এ আসনকে কেন টার্গেট করেছে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার গোলাম সাকলায়েন সমকালকে বলেন, সুমনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জাতীয় নির্বাচনে ঢাকার দুটি আসনে জামায়াত-শিবিরের নাশকতা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই গুলশান থানায় পাঁচটি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে গুলশান থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ডিবি সূত্র জানায়, গুলশানের শাহজাদপুরে সুমনের বাড়ি। তার বড় ভাই সোহেল গুলশান থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও বর্তমানে যুবলীগের স্থানীয় নেতা। নিরাপদে গোপন বৈঠকের জন্য সুমন তাদের বাড়ি ব্যবহার করত। সেখানে পরিকল্পনার বিভিন্ন নথিও রাখত। এ ছাড়াও সুমনের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ থেকে নির্বাচনে জামায়াত-শিবিরের নাশকতা পরিকল্পনার নানা তথ্য মিলেছে। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নাশকতা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা ওসমান জামানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ওসমান মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
অবশ্য সুমনের ভাই যুবলীগ নেতা সোহেল দাবি করেছেন, তিনি জানতেন না তার ভাই জামায়াত-শিবিরের নেতা। সে ভালো ছাত্র হওয়ায় জামায়াত তাকে টার্গেট করে গোপনে দলে টানতে পারে। বিষয়টি তাদের অগোচরেই হয়েছে।
জগিংয়ের নামে কর্মীদের ব্রিফিং :গোয়েন্দারা জামায়াত নেতা নাজমুল হক সুমনের মোবাইল ফোন থেকে বেশ কিছু ছবি উদ্ধার করেছে। এতে দেখা গেছে, সুমন ও ওসমানসহ জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা সকালে ঢাকার কোনো পার্কে জগিংয়ের পোশাকে ব্রিফিংও করছেন। বিভিন্ন পার্কে তারা ফুটবল খেলছে এমন ছবিও দেখা গেছে। এ বিষয়ে সুমন গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, বাসাবাড়িতে বৈঠক করলে পুলিশ হয়রানি করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে নির্বাচনে কেন্দ্রভিত্তিক দায়িত্বশীল নেতাদের নিয়ে তারা পার্কে জগিংয়ের নামে বৈঠক করে থাকেন। সুমন গোয়েন্দাদের তথ্য দিয়েছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব মাঠ, গুলশানের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ, সাবেক ওয়ান্ডারল্যান্ডের পশ্চিম পাশের মাঠ ও মিরপুর চিড়িয়াখানা এলাকায় তারা এ ধরনের বৈঠক করেন।
বিদেশি পর্যবেক্ষক দলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা : গোয়েন্দারা জামায়াত নেতার কাছ থেকে উদ্ধার করা নথি থেকে জানতে পেরেছেন, নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো থেকে যেসব প্রতিনিধি পর্যবেক্ষক হিসেবে আসবেন, জামায়াত-শিবিরের সংগঠকরা পরিচয় গোপন করে তাদের ভেতর অনুপ্রবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সহযোগী, গাড়িচালক বা দোভাষী হয়ে তারা নির্বাচন-সংক্রান্ত ভুল তথ্য সরবরাহ করবে। যেসব বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের দেখভালের দায়িত্বে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে দলটির প্রশিক্ষিত কর্মীদের নানাভাবে নিযুক্ত করা হয়েছে। জামায়াতের নেতারা তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে আমেরিকার অর্থায়নে ১৫ হাজার দেশীয় পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এখানে তাদের সংগঠকদের বেশি করে সংযুক্ত করতে হবে।
সুমনকে গ্রেফতার অভিযানে যুক্ত ডিবির সিনিয়র সহকারী কমিশনার হান্নানুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তার কাছে পাওয়া নথিতে নাশকতার পরিকল্পনা তো বটেই, নির্বাচনের দিন নাশকতায় অংশ নেবে এমন নেতাকর্মীদের নাম-ঠিকানাও মিলেছে। পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে।
প্রতি কেন্দ্রে ২০০ প্রশিক্ষিত কর্মী : উদ্ধার করা নথি থেকে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ঢাকা-১৫ ও ঢাকা-১৭ আসনের প্রতিটি কেন্দ্রে জামায়াত-শিবিরের ২০০ করে প্রশিক্ষিত কর্মী থাকবে। যাদের এরই মধ্যে কুংফু-ক্যারাতে ও লাঠি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই কর্মীদের মধ্যে একটি গ্রুপ গোয়েন্দা হিসেবে কার্যক্রম চালাবে। প্রয়োজনে সরকার সমর্থক প্রার্থীর ব্যাজ লাগিয়ে তারা বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরবে।
দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সুমনের কাছ থেকে উদ্ধার করা নথিতে দেখা গেছে, জামায়াত ও শিবির কর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে যে, ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশাসন ম্যানেজ করে তারা ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-১৫ আসনের মাঠ দখলে রাখবে। নিজেদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগে তারা বলেছে, 'মার খেলেও পাবলিকের কাছে যেতে হবে। পোস্টার ছিঁড়লে নগদ মাইর দিতে হবে।'
উদ্ধার করা নথিতে দেখা গেছে, ঢাকা-১৭ আসনের ধানের শীষের প্রার্থীকে উদ্ৃব্দত করে শিবিরের একটি গ্রুপ জানিয়েছে, 'চার দিন পর প্রশাসন চেঞ্জ হয়ে যাবে। তখন প্রথম প্রহরেই প্রতিরোধ করতে হবে।' হোয়াটসঅ্যাপে 'এম-ফিফটিন' ও 'ডিএনসিজে' নামে দুটি গ্রুপ থেকে তারা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়েছে।