ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই
জনতার জাগরণ, শেখ হাসিনার পতন

৫ আগস্ট ২০২৪, বা ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই। শুধুমাত্র একটি তারিখ নয়, সংগ্রাম ও সাহসের একটি অগ্নিঝরা দিন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে সোনালি অক্ষরে। এই দিনটি ছিল গণজোয়ারের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ— যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী সবাই যেন এক কণ্ঠে ঘোষণা করছিল— এই রাষ্ট্র আর চলবে না আগের নিয়মে। এবার নতুন বাংলাদেশের পথে হাঁটবে জাতি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন দিন খুব কমই এসেছে— যেদিন একটি রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে পড়ে মানুষের ঢেউয়ে, আর একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম হয় রাজপথে। একটি সরকার নয়, একটি যুগের অবসান। একদিনে ভেঙে পড়ে ১৬ বছরের ক্ষমতাসীন একচ্ছত্র শাসনব্যবস্থা। রক্তাক্ত রাজপথের প্রতিরোধ, লাখো মানুষের লংমার্চ, আর স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়ানো এক সাহসী প্রজন্মের বিজয়ের দিন।
জুলাই থেকে জ্বলছিল রাজপথ
২০২৪ সালের জুন মাসের শেষদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। জুলাই মাসে আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়, বিশেষ করে ১৬ জুলাই ২০২৪— যেদিন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডই ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো বিষয়। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই সারাদেশে শুরু হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন।
পতনের শুরু
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহজুড়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনাসহ দেশের প্রতিটি বড় শহরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ২৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ছাত্রনেতাদের গোপন সমাবেশে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’র রূপরেখা তৈরি হয়। এই অভ্যুত্থান ছিল কোনো রাজনৈতিক দলের আহ্বান ছাড়া নাগরিক সমাজের সক্রিয় সহায়তায় একটি বিশুদ্ধ ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ।
‘লংমার্চ টু ঢাকা’ এবং পতনের আনুষ্ঠানিকতা
তৎকালীন ‘জাতীয় ছাত্রঐক্য’, ‘নাগরিক মঞ্চ’ ও ‘স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্ল্যাটফর্ম’ ৫ আগস্টকে ‘গণজাগরণ দিবস’ ঘোষণা করে। সারা দেশ থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, ট্রাকে করে ঢাকার দিকে লংমার্চ করে। ফতুল্লা, আশুলিয়া, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ঢোকে লাখো মানুষ। দেশজুড়ে লংমার্চ: গণভবন অভিমুখে জনতার বহর। দিনাজপুর থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ঐক্যফ্রন্ট’, কক্সবাজার থেকে ‘উপকূল ছাত্র পরিষদ’, সুনামগঞ্জ থেকে কৃষক মিছিল, খুলনা-যশোর অঞ্চল থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলো সবাই একটাই স্লোগান তুলেছিল— গণভবন নয়, জনগণের ভবন চাই।
পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত রাজপথ
৩ ও ৪ আগস্ট— সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মেঘনা সেতু, মাওয়া ফেরিঘাট- এইসব প্রবেশপথে জনতার বহর থামাতে পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু হয়। গাজীপুর চৌরাস্তায় ৩ আগস্ট দুপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মো. সোহান নামে এক ছাত্র। এদিন মাওয়া ঘাটে শতাধিক নৌকায় করে আসা মানুষকে বাধা দিতে গিয়ে বিআইডব্লিউটিএ এবং র্যাবের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়।
৪ আগস্ট রাতে আমিনবাজারে ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় জনতার সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে আহত হন অন্তত ৪৫ জন। ঢাকা শহর হয়ে উঠে এক মুক্তাঞ্চল। বাংলাবাজার, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, সংসদ ভবনের সামনে— সবখানে শুধু মানুষ আর মানুষ। তাদের একটাই দাবি—নতুন বাংলাদেশ চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশী মোড়ে আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয়— আমরা আর এ রাষ্ট্রের জুলুম মানি না। এই রাষ্ট্রকে আমরা পুনর্গঠন করব জনগণের ইচ্ছায়। এ দিন থেকেই আমরা একটি দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের পথে যাত্রা করছি।
একটি নতুন ভোরের দিকে যাত্রা
৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল একটি দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলাফল। রক্ত, ঘাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দিনটি দেশের মানুষের মাঝে নতুন এক আশার জন্ম দেয়। সেদিন কেউ দল দেখে আসেনি, বর্ণ-ধর্ম বা অঞ্চল দেখে একত্র হয়নি— সবাই এসেছিল একটি নতুন দেশ গড়তে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ আগস্ট দিনটি শুধু একটি অভ্যুত্থান নয়, এটি ছিল জনগণের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের দিন। এই দিন দেখিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্র কেবল রাষ্ট্রপতির বা প্রধানমন্ত্রীর নয়, রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণ। আর যখন জনগণ জেগে ওঠে, তখন আগুন ঠেকানো যায় না, ইতিহাস থামানো যায় না।
৪৫ মিনিটের আলটিমেটামে শেখ হাসিনার নিঃশব্দ প্রস্থান
৫ আগস্ট সকালে পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, সেনাবাহিনী একটি বিশেষ বৈঠক বসে। এর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে চান। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেও ভাষণ অনুষ্ঠিত হয় না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সরাসরি শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন, ‘আপনার হাতে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় আছে। এর পর সেনাবাহিনী আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না।’
বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রায় ১৬ বছরের একদলীয় শাসনের পর্দা নামে। যা ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, মতপ্রকাশের অবদমন ও নাগরিক অধিকার হরণের আরেক নাম।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ বার্তা
দুপুরের পর সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিশ্চিত করেন। এই ঘোষণার পর ঢাকায়, চট্টগ্রামে, খুলনায়, সিলেটে— চতুর্দিকে জনতার উল্লাস ও বিজয় উদযাপন শুরু হয়।
শহিদের রক্তের ঋণ ও পতন
৫ আগস্ট শুধু শেখ হাসিনার প্রস্থান হয়নি— এটি ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রিক, দমন-পীড়নভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান। শহিদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে কেবল শাসক বদল নয়, ব্যবস্থা বদল জরুরি— এই ছিল সেদিনের শিক্ষা। সেদিন রাজপথে লেখা হয়েছিল— ‘রাষ্ট্রে আর কেউ চিরস্থায়ী নয় জনগণ ছাড়া।’
গণভবন ও সংসদ ভবনে জনতার পদচারণা
শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাজারো মানুষ গণভবনে প্রবেশ করে বিজয় উদযাপন করে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশু, নারী, বৃদ্ধ, শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী সবাই মিলে উদযাপনে শরিক হন।
কেউ সেলফি তোলে গণভবনের সামনে, কেউ জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, কেউবা শহিদদের নাম লিখে দেয়ালের গায়ে আঁকে— ‘এই রক্তের ঋণ কোনো দল নয়, জনগণই শোধ করবে।’
শেষ মুহূর্তেও রক্তপাত
পতনের খবর নিশ্চিত হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের কিছু অনুগত ক্যাডার বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। শাহবাগ, পল্টন, মিরপুর, চট্টগ্রাম-সীতাকুণ্ড ও খুলনায় পুলিশি হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হন। রক্তমাখা পতনের দিন তাই একদিকে যেমন ছিল বিজয়ের মুহূর্ত, তেমনি ছিল মর্মান্তিক বেদনারও।
ইতিহাসের মোড় ঘুরানো দিন
৫ আগস্ট কেবল শেখ হাসিনার পতনের দিন নয়, এটি শহিদের আত্মত্যাগ, জনগণের ঘৃণা, যুবসমাজের স্বপ্ন, আর গণমানুষের প্রত্যয়ে ভরপুর এক নতুন সূর্যোদয়ের দিন। এই দিনেই প্রমাণ হয়েছে— স্বৈরাচার যতই শক্তিশালী হোক, জনগণের ঐক্যই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শক্তি।’ আজ সেইদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা হলো— রক্ত, প্রতিরোধ ও জয়গানে।