মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত
পোড়া ব্যাগ হাতে অশ্রুসিক্ত স্বজনরা

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার ছয়দিন পর ক্যাম্পাসে এসেছেন এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। শনিবার (২৬ জুলাই) দুপুরে তিনি যখন কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বাম হাতে শিশুসন্তানের হাত ধরা এবং ডান হাতে একটি স্কুলব্যাগ। ব্যাগের গায়ে পোড়া দাগ। স্কুলব্যাগটি নিয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় দেখা গেল ওই অভিভাবকের চোখ ছলছল করছে।
ওই অভিভাবক বলেন, আমার ছেলের স্কুলব্যাগ নিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তকালে ছেলেও হায়দার আলী ভবনে ক্লাস করছিল। ঘটনার অল্প কিছু আগে সে ক্লাসরুমে ব্যাগটি রেখে বাইরে বের হয়েছিল। তাই হয়তো আল্লাহ আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেক বাচ্চার মর্মান্তিক মৃত্যু হলো। স্কুল ক্যাম্পাসের ভেতরে সেই ধ্বংসস্থলে চোখ যেতেই বুকের ভেতরে কেমন জানি হচ্ছিল। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আজ ছেলের স্কুলব্যাগটি সংগ্রহ করলাম।
কেবল ওই একজন অভিভাবক নন, গতকাল আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবককে স্কুলে আসতে দেখা যায়। যাদের অধিকাংশই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। তবে ক্যাম্পাসে ঢুকে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে নিজ নিজ সন্তানের স্কুলব্যাগ ও বইখাতাসহ ফেলে যাওয়া সামগ্রী নিয়ে যেতে দেখা যায়।
গত জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান আকস্মিকভাবে বিধ্বস্ত হলে যে যেভাবে পারে- সব ফেলে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে।
গতকালও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ফটকে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হায়দার আলী ভবনটি একনজর দেখতে জড়ো হয়েছিলেন অনেকেই। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না তখনো। এদিকে স্কুল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা কলেজ ফটকে এসে নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে তাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে।
পরিচয় না জানিয়ে অপর একজন অভিভাবক বলেন, স্কুল ছুটি হলে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে খেতে ক্যান্টিনে এসেছিল ছেলে। তার তিন-চার মিনিট পরই ওই ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। স্কুলের শিক্ষার্থীরা জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করছিল। তখন আমার ছেলে ভয় ও আতঙ্কে ক্যান্টিনের সামনে ছিল। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ওই দিন আমার সন্তান যদি ক্লাসরুমে থাকত, আমরাও ওকে হারাতাম। আল্লাহ ওকে বাঁচিয়েছে। বাবার হাত ধরে তখন দাঁড়িয়ে ছিল শিশুটি।
গতকাল দুপুর ১টার দিকে উত্তরা জয়নাল মার্কেট এলাকা থেকে আরিফুজ্জামান নামে একজন দর্শনার্থী কলেজ ফটকে দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করছিলেন, বিমানটি স্কুলের কোথায় পড়েছিল? উত্তরে সিকিউরিটি গার্ড আবু রায়হান হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বলেন, এই পথ দিয়ে সামনে গেলেই, টিন দিয়ে ঘেরা হায়দার আলী ভবনে। ওই দর্শনার্থী জিজ্ঞেস করেন, ভেতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে?' উত্তরে রায়হান বলছিলেন, 'দর্শনার্থীদের ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি এখনো পাইনি। পেলে গেট খুলে দেব।'
১টা ২০ মিনিটে কলেজ ফটক খুলে দিলে দর্শনার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ কলেজ ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন। দুপুর দেড়টার সময় ফটকে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা জানান, হায়দার আলী স্কুল ভবনটি আগে ছাত্র হোস্টেল ছিল। গত এক বছর হলো সেখানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চালু করে কর্তৃপক্ষ। আগে হোস্টেল ছিল বিধায় গ্রিল দিয়ে আটকে এটি খাঁচার মতো করে তৈরি করা।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সব ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও কয়েকটি ভবনে ইমার্জেন্সি এক্সিট সিঁড়ি নেই। এগুলোর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হায়দার আলী ভবন, গার্লস হোস্টেল হাজেরা ভবন, এন কে ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি রয়েছে। বাকি ভবনগুলোতে ইমার্জেন্সি এক্সিট সিঁড়ি রয়েছে।
ফটকের সামনে উপস্থিত মাইলস্টোন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাফরিন রহমান মেহের বলেন, আমরা যখন ভবনটির সামনে দিয়ে যাব বা জানালা দিয়ে দেখব, তখন ঠিকই মনে পড়বে- আমি দেখেছি বাচ্চাগুলো চিৎকার করছে, বাচ্চাগুলো পুড়ে যাচ্ছে। এগুলো তো ভুলতে পারব না। এই ট্রমা আমাদের সারা জীবন থাকরে। এখন একটা বিমান উড়ে গেলে ভয়ে হাত-পা কাঁপে। রাতে যে কয়বার বিমান এই এলাকা ক্রস করে আমার ঘুম ভেঙে যায়। একটা ভয় কাজ করে মনে।
ক্যাম্পাস প্রসঙ্গে এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস এখানে গড়ে উঠেছে। এটি এক-দুদিনে গড়ে ওঠেনি। মাসের পর মাস নির্মাণকাজের মাধ্যমে এই ক্যাম্পাস হয়েছে। এটি নির্মাণে অনুমতি দিল কে? রাজউক, সরকারের সংশ্লিষ্টরা? দোষ তো তাদের (সরকার), তারা কেন অনুমতি দিল? অনুমতি না দিলে এখানে ক্যাম্পাস হতো না। আর আজ এমন দুর্ঘটনাও ঘটত না।
গতকাল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ধাপে ধাপে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আগামীকাল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এদিকে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি যেন না হয়, সেটিই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর আমরা প্রথমেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছি।