জুলাই গণঅভ্যুত্থান
গত ১১ মাসে মামলা ১৬০১, চার্জশিট ১২

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে দায়ের করা ১৬০১টি মামলার মধ্যে ১২টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৩টি এবং অন্যান্য ধারায় মামলা ৯টি। পুলিশ সদর দফতর এ তথ্য জানিয়েছে।
চার্জশিট দেওয়া তিনটি হত্যা মামলার সবগুলোই শেরপুর জেলার। অন্যান্য ধারার ৯টি মামলার মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তিনটি, সিরাজগঞ্জ জেলার দুইটি এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের দুইটি।
পুলিশ সদর দফতরের এআআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশ সদর দফতরের মনিটরিং-এর মাধ্যমে মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। অনেক মামলারই তদন্তে অগ্রগতি আছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সারাদেশে এক হাজার ৬০১টি মামলা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৬৩৭টি হত্যা মামলা। বেশির ভাগ মামলা হয়েছে গত বছরের ১৯ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্টের হতাহতের ঘটনায়। এসব মামলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি তদারকি পুলিশ সদর দফতরের। ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। পর্যায়ক্রমে এসব মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানায় পুলিশ সদর দফতর।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারে নিহত হন স্কুল ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ। ওই ঘটনায় তার বাবা কামরুল হাসান লালবাগ থানায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৭ জন গ্রেফতার হয়েছে বলেন জানান তিনি। তার অভিযোগ, এহাজারভুক্ত অনেক আসামি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ তারা আমাকেই বলছে চেষ্টা করে লাভ নাই, পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করবে না।
তিনি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ আসামিদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করছে না, অজ্ঞাত আসামিদের গ্রেফতার করছে। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও দেখা করেছি। আসামিদের গ্রেফতার করে দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার অনুরোধ করেছি।
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ নিহত হন ১৯ জুলাই উত্তরায়, পেশায় ছিলেন গাড়ি চালক। তার স্ত্রী ফারজানা বেগম জানান ওই ঘটনায় আসাদুল্লাহর মা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ফারজানা বলেন, ‘মামলায় কতজন আসামি, কেউ গ্রেফতার হয়েছে কী না তার কিছুই আমি জানি না। আমার শাশুড়িও জানে না। তার সাথে কথা বললে তিনি কিছু বলতে পারেন না। পুলিশও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। আসলে এই মামলার ব্যাপারে আমরা কোনো খবর এখন আর রাখি না।
৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ সদরে নিহত হন সজল মিয়া। তার ভাই সেলিম রায়হান বলেন, আমি বাদী হয়ে ৩০১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছি। প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি ছবি দেখে দেখে সব আসামিকে চিহ্নিত করেছি। মোট ১০৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও এরইমধ্যে ৯৪ জন জামিনে বের হয়ে এসেছে। তারপরও আমি তদন্তে সন্তুষ্ট। পুলিশ চার্জশিট দেবে কবে জানি না।
এই মামলাগুলো নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিমাসেই মনিটরিং সেলের মিটিং হচ্ছে। মামলাগুলোর তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন সেখানে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়। পুলিশ সদর দফতর ছাড়াও রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের একজন অতিরিক্ত ডিআইজি মামলাগুলো মনিটরিং করেন বলে জানান ঢাকা রেঞ্জর ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক৷
শেরপুর জেলার পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা কঠোর মনিটরিং-এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠছি। লাশ দাফনের সময় যারা ছিলেন তাদের সাক্ষ্য নিয়ে ময়না তদন্তের জটিলতা কাটাতে পারছি। ঘটনাস্থল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে নিশ্চিত হচ্ছি। এছাড়া ভিডিও ফুটেজ আমাদের বেশ সহায়তা করছে। আমরা ভিডিও ফুটেজগুলো সংগ্রহ করে আসামি চিহ্নিত, ঘটনাস্থল চিহ্নিত এবং কীভাবে নিহত হয়েছে তা নিশ্চিত হতে পারছি। আর আমার জেলায় একজন সলিসিটার নিয়োগ করা হয়েছে মামলাগুলোর জন্য। তিনি তদন্তের আইনগত দিক দেখছেন। আমরা কীভাবে এগোবো তার পরামর্শ দিচ্ছেন। এছাড়া পুলিশ সদর দফতর মনিটরিং করছে। আইজিপি সাহেব সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলছেন।
ভুয়া আসামি বা জড়িত নয় এমন আসামিদের মামলা থেকে বাদ দিতে এরইমধ্যে সিআরপিসির ১৭৩ ধারা সংশোধন করা হয়েছে। এর ফলে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাওয়া সহজ হবে। আর তা হলো তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি তদন্ত পর্যায়ে কাউকে নিরপরাধ মনে করেন তাহলে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে তা লিখিতভাবে জানাবেন। তিনি সেটা আদালতে পাঠালে আদালত তাকে মামলা থেকে রেহাই দিতে পারবেন৷ আবার পরে দায়ী মনে করলে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন।
পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এতে সুবিধা হলো যারা অপরাধী নন তাদের আগেই রহাই দেওয়া যাবে। আসামির সংখ্যা কমে আসবে, তদন্ত সহজ হবে।
তবে সিআরপিসির এই সংশোধন দরকার ছিল না বলে মনে করেন সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান। তিনি মনে করেন, চার্জশিটেই নিরাপরাধ ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল। এখন যেটা হবে তদন্ত শেষে, আগে রেহাই পাওয়াদের আবার আসামি করা হতে পারে।
তিনি বলেন, পুলিশে অনেক গ্যাপ তৈরি হয়েছে। দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তার অভাব দেখা দিয়েছে, এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর ময়না তদন্ত সংক্রান্ত জটিলতা দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তারা সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে এড়াতে পারেন।
এদিকে মামলাগুলোর বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মামলার চার্জশিট না হলে বিচার শুরু সম্ভব হচ্ছে না।
খান সাঈদ হাসান বলেন, মামলার তদন্ত শেষ করতে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। আর অবকাঠামোগত সুবিধাও বাড়াতে হবে। তা না হলে কতদিনে তদন্ত শেষ হবে সেটাই প্রশ্ন।
তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মো. তালেবুর রহমান বলেন, ওই মামলাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রতিটি পর্যায়ে মটিরিং করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই। মামলার দ্রুত তদন্ত শেষ এবং নিরাপরাধ যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ছাড়াও সিআইডি, ডিবি, পিআইবি মামলাগুলোর তদন্ত করছে।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আগেই নির্দেশ দিয়েছে গত ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ‘জুলাই গণ-অভুত্থান’ সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না। এই গণ-অভ্যুত্থানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে কাজ করেছেন। ফলে পুলিশ সদর দফতরের হিসাব মতে ৪৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার তদন্তের কী হবে তা এখনো স্থগিত আছে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে