ঢাকা শুক্রবার, ১৫ই আগস্ট ২০২৫, ১লা ভাদ্র ১৪৩২


এসএসসির ফল

ফল তৈরিতে গুরুত্ব পেয়েছে প্রকৃত মূল্যায়ন, তাই কমতে পারে ‘এ প্লাস’


প্রকাশিত:
১০ জুলাই ২০২৫ ১৩:৩৩

ছবি : সংগৃহীত

পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল।

আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুর ২টায় দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে একযোগে ফল প্রকাশের কথা রয়েছে। ফল জানা যাবে অনলাইন, এসএমএস ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।

এবার ফল তৈরিতে গুরুত্ব পেয়েছে প্রকৃত মূল্যায়ন। যে শিক্ষার্থী যে পরিমাণ লিখেছেন তার ওপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা হয়েছে ফল। এতে করে এবার ‘এ প্লাস’ কিছুটা কমে আসতে পারে বলে আগাম ইঙ্গিত মিলেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবারের এসএসসি ফল কিছুটা ব্যতিক্রম হবে। কারণ, দীর্ঘদিন পর এবার ‘সহানুভূতির নম্বর’ দেওয়া বন্ধ করে খাতা মূল্যায়নে বাস্তবতার পথে হাঁটছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। ফলাফল নির্ধারণে শিক্ষার্থীর প্রকৃত উত্তরের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখলেই নম্বর পাওয়ার দিন শেষ— এমনটাই জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বোর্ড কর্মকর্তারা।

এদিকে, গত এক দশকের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হারে এক প্রকার উল্লম্ফন দেখা গেছে। ২০০১ সালে প্রথম গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর বছর মাত্র ৭৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলেও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সংখ্যার দিক দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের ছবি আঁকা গেলেও গুণগত মান নিয়ে ছিল প্রশ্ন। জিপিএ-৫ পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে, এমনকি মানসিক চাপে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

শিক্ষাবোর্ডের একাধিক পরীক্ষক জানান, অতীতে ২৮ বা ৩০ নম্বর পেলেও পরীক্ষার্থীকে ৩৩ করে পাস করিয়ে দেওয়ার অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হতো। এমনকি অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দিলেও নম্বর দেওয়ার নজির রয়েছে। তবে এবার সেই ধারায় ছেদ টানা হয়েছে।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, খাতা মূল্যায়নে আমরা উদার বা কঠোর নই, বরং বাস্তবতার ভিত্তিতে সঠিক মূল্যায়নের ওপর জোর দিচ্ছি। বেশি জিপিএ-৫ নয়, বরং ভালো মানের শিক্ষার্থী তুলে আনা আমাদের লক্ষ্য।

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, শুধু সংখ্যার নয়, গুণগত মানের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়বে। তাই শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেন, বাহুল্য এড়িয়ে, গতি ও নির্ভুলতা বজায় রেখে ফল প্রকাশ হচ্ছে। ফল প্রকাশে অহেতুক জাঁকজমক নয় বরং গুরুত্ব পাচ্ছে স্বচ্ছতা।

অন্যদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে এসএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির এক ভয়াবহ চিত্র। জরিপে দেখা গেছে, ফরম পূরণ করার পরও ৬ হাজার ৩৮৯ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৩৫০ জন অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪২ শতাংশ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বিয়ের কারণে। তাদের ৯৭ শতাংশই ছাত্রী, এবং এদের বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা।

জরিপে আরও দেখা যায়, অনুপস্থিতদের মধ্যে ২৫ শতাংশ অসুস্থতা, ১২ শতাংশ প্রস্তুতির অভাব, ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বিদেশে চলে যাওয়া, ১ দশমিক ৬ শতাংশ গর্ভধারণ এবং ১ দশমিক ৪ শতাংশ মৃত্যুজনিত কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি। অনুপস্থিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল মানবিক বিভাগ থেকে—৬৮ শতাংশ, যার মধ্যে বড় একটি অংশ মেয়ে এবং গ্রামাঞ্চলের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, এসএসসি পরীক্ষার শুরু থেকেই অনুপস্থিতি দেখে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ, এসএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ছাত্র ও ছাত্রীদের এই হারে অনুপস্থিত হওয়া আমাদের জন্য বড় অশনি সংকেত। আর জরিপের পর দেখা গেছে বিয়ের কারণে বিপুল সংখ্যক কিশোরীর শিক্ষাজীবন থেমে গিয়েছে। যা আমাদের রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে।

আবার জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ জানিয়েছে তারা আর পড়বে না, যাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশই মেয়ে। অবশ্য শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে এরইমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মেয়েরা বড় হলেই বিয়ে দিতে হবে—এই মানসিকতা এখনো সমাজে গেঁথে আছে। দিনমজুর পরিবারে সন্তান পড়ানো বিলাসিতা মনে করা হয়, তাই মেয়েদের পড়াশোনার বদলে বিয়েকে সমাধান হিসেবে দেখা হয়।

ফল প্রকাশে থাকবে না আনুষ্ঠানিকতা
এবছর অতীতের মতো ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত হচ্ছে না কোনো আনুষ্ঠানিকতা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে অনাড়ম্বরভাবে। এমনকি কোনো মন্ত্রীপর্যায়ের ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়াই।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার জানিয়েছেন, অনাড়ম্বরভাবেই এ বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না। ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নিজেদের মতো করে ফল প্রকাশ করবে।

অবশ্য, অতীতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা শিক্ষামন্ত্রীর হাতে বোর্ড প্রতিনিধিরা ফল তুলে দিতেন। তারপর হতো সংবাদ সম্মেলন, বিশেষ অনুষ্ঠান ও ছবি তোলার আনুষ্ঠানিকতা।

যেভাবে দেখা যাবে এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফল
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে দুপুর ২টায়। আর ফল জানা যাবে অনলাইন ও এসএমএস—উভয় মাধ্যমেই। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা www.educationboardresults.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে নিজের ফল দেখতে পারবে। মোবাইল থেকে ফল জানতে মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখতে হবে — SSC [বোর্ডের প্রথম তিন অক্ষর] [রোল নম্বর] 2025—এবং পাঠাতে হবে ১৬২২২ নম্বরে (যেমন : SSC Dha 123456 2025)।

এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। এরমধ্যে ছাত্রী ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৯ জন এবং ছাত্র ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ জন। সারা দেশের ৩ হাজার ৭১৫টি কেন্দ্রে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দাখিল পরীক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে একই রকম পদ্ধতি। তারা চাইলে www.bmeb.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘অনলাইন সেবা-১’ কর্নার থেকে ‘দাখিল পরীক্ষা ২০২৫’ অপশন সিলেক্ট করে জেলা ও কেন্দ্রভিত্তিক ফল দেখতে পারবে। এছাড়া www.educationboardresults.gov.bd-এ গিয়েও রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে ব্যক্তিগত ফল জানা যাবে। মোবাইল থেকে ফল পেতে লিখতে হবে — Dakhil MAD [রোল নম্বর] 2025—এবং তা পাঠাতে হবে ১৬২২২ নম্বরে (যেমন : Dakhil MAD 123456 2025)।

প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ফলাফল জানার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা https://eboardresults.com/v2/home ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘ইআইআইএন’ নম্বর ব্যবহার করে ‘Institution Result’ অপশন থেকে সামগ্রিক ফল ডাউনলোড করতে পারবেন। ফল প্রকাশের পরপরই বোর্ড কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ওয়েবসাইট থেকে কেন্দ্র সচিব ও প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও ফল সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেবেন।

সুযোগ রয়েছে ফল রিভিউয়ের, প্রতি বিষয়ে লাগবে ১৫০ টাকা
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর যেসব শিক্ষার্থী মনে করবেন, তাদের প্রাপ্ত নম্বর প্রত্যাশার তুলনায় কম এসেছে বা মূল্যায়নে কোনো ভুল হয়েছে—তারা খাতা পুনঃনিরীক্ষার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন। এ আবেদন গ্রহণ শুরু হবে ১১ জুলাই থেকে এবং চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। তবে আবেদন করা যাবে শুধুমাত্র টেলিটক মোবাইল অপারেটর ব্যবহার করে। প্রতি বিষয়ের জন্য আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ টাকা।

আবেদন করতে মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করতে হবে — RSC <স্পেস> বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর <স্পেস> রোল নম্বর <স্পেস> বিষয় কোড এবং তা পাঠাতে হবে ১৬২২২ নম্বরে। একাধিক বিষয়ের আবেদন করতে চাইলে বিষয় কোডগুলো কমা (,) দিয়ে আলাদা করে লিখতে হবে (যেমন : ১০১,১০২)।

শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে টেলিটক তাদের ওয়েবসাইট www.teletalk.com.bd-এ আবেদন প্রক্রিয়া, বিষয় কোডসহ বিস্তারিত নির্দেশনা প্রকাশ করবে।

বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পুনঃনিরীক্ষণ বলতে খাতার নতুন করে মূল্যায়ন নয়, বরং পূর্বে প্রদত্ত নম্বর সঠিকভাবে যোগ হয়েছে কি না, কোনো প্রশ্ন বাদ পড়েছে কি না বা মূল্যায়ন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে কি না—সেসব বিষয় যাচাই করা হয়। তবে যারা আবেদন করতে চান তাদের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই আবেদন সম্পন্ন করতে হবে।

পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থী
শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। এরমধ্যে ছাত্রী ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৯ জন এবং ছাত্র ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ জন। সারা দেশের ৩ হাজার ৭১৫টি কেন্দ্রে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অবশ্য এর আগে, ২০২৪ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। সে তুলনায় ২০২৫ সালে পরীক্ষার্থী কমেছে প্রায় এক লাখ। আর ২০২৪ সালে তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৪৮ হাজার পরীক্ষার্থী কমেছিল।