পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প: ২০ লাখ টাকা বেতনে অদক্ষ পরামর্শক!

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ রেল রুট। ঢাকা থেকে মাওয়া, ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত এ রেলপথটির দৈর্ঘ্য ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার। চীনের অর্থায়নে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটির ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি)। তবে প্রকল্পটির বিদেশি পরামর্শক খুবই অদক্ষ, যদিও তার মাসিক বেতন প্রায় ২০ লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্পটির পরিচালক রেলওয়ের প্রকৌশলী না হওয়ায় রেলবিষয়ক কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই। এছাড়া রেল সংযোগ প্রকল্পের নকশাতেও ত্রæটি দেখা দিয়েছে। এতে পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগের সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে মাওয়ার দিকে ভায়াডাক্টের (উড়ালপথ) নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
যদিও এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্রকল্পটির ২২ পরামর্শককে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ঘনঘন পরামর্শক প্রতিস্থাপন ও অদক্ষতার ফলে প্রকল্পটির কাজ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তথ্যমতে, প্রকল্পটির বিদেশি পরামর্শক সিনিয়র কোয়ালিটি সার্ভেয়ার খুবই অদক্ষ। যদিও পরামর্শক টিমের অন্যতম এ এক্সপার্টের মাসিক বেতন ১৯ লাখ ৭১ হাজার ২৫০ টাকা। তবে উচ্চ বেতনে নিয়োজিত এ পরামর্শকের পারফরম্যান্সে অসন্তুষ্ট প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এজন্য পরামর্শক প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। গতকাল এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে জানানো হয়, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট দলের সিনিয়র কোয়ালিটি সুপারভাইজার হিসেবে বিদেশি পরামর্শক রোসান্ডো এফ ডেলা কুরুজ জেডআর ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে নিয়োজিত আছেন। ডিফেক্ট লায়াবিলিটি প্রিরিয়ডসহ ৫০ মাসের জন্য তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে তার নিয়োগের ২৪ মাস শেষ হয়েছে।
যদিও উল্লিখিত পরামর্শক প্রকল্পটিতে নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে আশানুরূপ কর্মদক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কোয়ান্টিটি সার্ভেয়ারদের পক্ষ থেকে পাঠানো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও তিনি অপারগতা প্রকাশ করে আসছেন। যে কোনো মিটিংয়ে তার পূর্বপ্রস্তুতি থেকে সুস্পষ্ট মতামত পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই পরামর্শকের কার্যক্রমে সিনিয়র কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিস্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এসিইর কাছে প্রস্তাব চাওয়া হলে তারা রাল্ফ ব্রোঘটনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করে। অবশিষ্ট ২৬ মাসের জন্য তাকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে রেলের গঠিত পরামর্শক প্রতিস্থাপন কমিটি। তার মাসিক বেতনও ধরা হয়েছে ১৯ লাখ ৭১ হাজার ২৫০ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ. চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যদিও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের অদক্ষ পরামর্শকের প্রতিস্থাপনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, পরামর্শক অদক্ষ হলে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হয়। তাই পরামর্শক প্রতিস্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। অনেকে বিষয়টি গোপন রাখলেও রেলওয়ে ভালো কাজ করেছে। এ বিষয়ে বুয়েটের মতামত চাওয়া হয়েছিল। আর অদক্ষ হওয়ায় স্বেচ্ছায় প্রকল্পটি থেকে সরে যেতেও সম্মত হয়েছেন ওই পরামর্শক।
সূত্রমতে, শুধু পরামর্শকই নয়, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক নিয়েও রয়েছে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের অসন্তোষ। কারণ তিনি রেলওয়ের কর্মকর্তা বা প্রকৌশলী নন। অতিরিক্ত সচিব পদ মর্যাদার এ আমলাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাই রেলপথ নির্মাণ-সম্পর্কিত তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এর পরও সম্প্রতি তার মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ভায়াডাক্টের (উড়ালপথ) সঙ্গে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের কয়েকটি স্থানে রয়েছে সাংঘর্ষিক অবস্থা। এর মধ্যে ভায়াডাক্টের পি২৫-১ ও পি২৫-২ পিলারে সমস্যা বেশি। এ পিলার দুটি নির্মাণ করতে গিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য নির্মিত সংযোগ সড়কের কিছু অংশ কেটে ফেলেছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার সিআরইসি। এছাড়া ওই পিলার দুটির উচ্চতা ভ‚মি থেকে ছয় মিটারের কম, যা সংযোগ সড়কে যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ওই অংশের নকশা সংশোধনের কাজ চলছে। এক্ষেত্রে পিলার দুটি ভেঙে আবার নির্মাণ করার দরকার হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে নেয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের ঋণ (বায়ার্স ক্রেডিট)। যদিও ২০১৮ সালে প্রকল্পটির নির্মাণব্যয় এক দফা বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দেবে চীন। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে। যদিও ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।
এদিকে রেলপথটি নির্মাণব্যয় সম্প্রতি আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে এক হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এতে রেলপথ নির্মাণব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪০ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির নকশা জটিলতার কারণে রেলপথ নির্মাণব্যয় আরও বাড়বে। এর বাইরে বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণেও প্রকল্প ব্যয় বাড়তে পারে। রেলপথটি নির্মাণের শেষ দিকে এসব ব্যয় সমন্বয় করা হতে পারে।