ঢাকা বুধবার, ১৪ই মে ২০২৫, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


মুখোমুখি সম্রাট-আরমান একে অন্যকে দোষারোপ


২৫ অক্টোবর ২০১৯ ১৩:৩৩

আপডেট:
১৪ মে ২০২৫ ১১:১৯

ক্যাসিনো কারবার চালিয়ে বিপুল অর্থের মালিক ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের (বহিষ্কৃত) সহসভাপতি এনামুল হক আরমান। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের পাশাপাশি ইউরোপের একটি দেশের এক এনজিওতেই তার বিনিয়োগ আছে ১৭ কোটি টাকা। আর ‘শখের বশে’ চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রেখে সেখানে বিনিয়োগ করেছেন ৪ কোটি টাকা। রিমান্ডে আরমানের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

একইদিন রিমান্ড (অস্ত্র ও মাদকের দুই মামলা) শেষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাকে ১০ দিনের রিমান্ড শেষে এদিন আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত

তাকে কারাগারে রাখার আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। সম্রাটের আইনজীবীরা তার জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহ তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আর আরমানকে অস্ত্র মামলায় গতকাল পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। গত ৬ অক্টোবর কুমিল্লার একটি গ্রাম থেকে সম্রাট ও আরমানকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। গত ১৫ অক্টোবর তাদের অস্ত্র ও মাদক মামলায় পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।

তদন্তকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আরমান জানিয়েছেন, ক্যাসিনোসহ যতসব অপকর্ম তিনি করেছেন তার পেছনে একমাত্র প্রেরণা দিয়েছেন সম্রাট। তিনি নিজ থেকে কিছু করেননি। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে সম্রাট ও আরমানকে মুখোমুখি করা হয়। তখন তারা একে অন্যকে দোষারোপ করেছেন। এরপর থেকে তাদের আলাদাভাবে রাখা হয়। সম্রাটের বিদেশে ফ্ল্যাট থাকলেও আরমানের বিদেশে কোনো ফ্ল্যাট নেই বলে দাবি করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক কিছু গোপন করার কারণে আরমানকে ফের দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফা রিমান্ডে তার যুবলীগের রাজনীতিতে উঠে আসা, ক্যাসিনো থেকে অর্থ আয় ও পাচার, বিদেশে অর্থের দেখভাল কারা করতেন, চলচ্চিত্রে জড়িয়ে যাওয়া ও একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা সবিস্তারে খুলে বলেছেন। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রথম দফার রিমান্ডে আরমান তার ব্যক্তিগত কথা কিছুটা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি সম্রাটের ‘প্রডাক্ট’। সম্রাট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরেই তাকে ওই ইউনিটের সহসভাপতি নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে সম্রাটের ভ‚মিকা ছিল বেশি। তার প্রতিদানে সম্রাটের অগ্রজ হিসেবে তার সব কর্মকাণ্ডে তিনি অংশ নিয়েছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় যে ক্যাসিনো চলত তার বড় একটি অংশ ভাগ পেতেন আরমান। এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মগবাজার লেগুনাস্ট্যান্ড, মগবাজার কাঁচাবাজার, মগবাজার রিকশার গ্যারেজ ও খিলগাঁও লেগুনাস্ট্যান্ড তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। দুই বছর আগে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সম্রাটের আরেক সহযোগী খালেদের সঙ্গে তার দ্ব›দ্ব শুরু হয়। তখন সম্রাটের হস্তক্ষেপে তা সমাধান হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে আরমানের আয় হওয়া অর্থ কোথায় রেখেছেন তা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি বলেন, দেশের তিনটি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট আছে। বাংলাদেশের ব্যাংকে তার কোনো উল্লেখযোগ্য টাকা নেই বলে তিনি দাবি করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার ওই তিনটি অ্যাকাউন্টে লেনদেনের উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাননি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বিদেশের ব্যাংকে ও এনজিওতে তার টাকা রয়েছে বলে দাবি করেন আরমান। তার অবৈধ টাকা তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। ব্যাংকের মাধ্যমে বা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে পড়তে পারেন সেজন্য তিনি হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন। ইউরোপের দেশ লাটভিয়ার ‘কিংস্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে একটি এনজিওতে তার ১৭ কোটি টাকা রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন। ওই টাকা বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচারে মূল ভ‚মিকা রেখেছেন মতিঝিলের হুন্ডি কারবারি শামসুল ইসলাম। ফকিরাপুলের ৭৬-ক নম্বর বাসায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভ‚ঞার ওমরাবাদ এলাকায়। আরমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই বাসার জিনিসপত্র নিয়ে শামসুল তালা লাগিয়ে পালিয়েছেন। র‌্যাব তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। শামসুলের এক আত্মীয় থাকেন লাটভিয়ায়। সেই সূত্র ধরেই আরমান ওই দেশে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, আরমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, ছোট থেকেই চলচ্চিত্রে কাজ করার শখ ছিল তার। যুবলীগের নেতা হওয়ার পর ক্যাসিনোতে ভাগ্য খুলে যাওয়ার কারণে তিনি চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করা শুরু করেন। চলচ্চিত্রে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ বলে একটি সিনেমা দেশের হলগুলোতে মুক্তি পেয়েছে। গ্রেপ্তারের তিন মাস আগে তিনি কলকাতায় যান। এপার-ওপার বাংলার তারকাদের নিয়ে তিনি একটি সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ওই সিনেমায় কলকাতার অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় ও অভিনেতা তাপস পালের অভিনয়ের কথা ছিল। কলকাতায় যাওয়ার সময় তিনি বাংলাদেশের শিরীন শিলা নামে এক অভিনেত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, রিমান্ডে সম্রাট তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে জানিয়েছেন, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে অর্জিত কোটি কোটি টাকা তিনি ওড়াতেন জুয়া খেলে। সিঙ্গাপুর যেতেন নিয়মিত। সেখানে প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা ‘মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে’ জুয়া খেলতেন। প্রথমসারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হতেন আরমান, মমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা  বলেন, ২০১৮ সালে সম্রাটের বিরুদ্ধে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে। এ খবর জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন। আঞ্জুমানকে প্রধানমন্ত্রী নিজে ও তার বোন শেখ রেহানা বিভিন্ন সময়ে অনুদান দিয়ে আসছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সম্মেলনে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী যুবলীগ দক্ষিণের কমিটি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে যান। এরই মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সম্রাটের জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার পরিচালনার তথ্য পান প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী কানাডা সফরে গেলে মতিঝিল এলাকার সাবেক একজন ছাত্রনেতা সম্রাটের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তোলেন। সম্রাটের কারণেই তিনি রাজনীতি ছেড়ে কানাডা চলে গেছেন বলে জানান। প্রধানমন্ত্রী সম্রাটের জুয়া, ক্যাসিনো ব্যবসার নাম উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।