ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিতেও লজ্জা পাচ্ছেন সাবেকরা!

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর অনেক সোনালি অর্জনের অংশীদার ছাত্রলীগ নব্বই-পরবর্তী সময়ে পথ হারিয়েছে বলে মনে করেন সংগঠনটির সাবেক নেতারা। তারা বলছেন, দেশের সব লড়াই-সংগ্রামে ও জাতীয় ইস্যুতে জনমত তৈরির কাজটিও করেছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠনটি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রাণও গেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। তারা যেখানে দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে এখনকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই আসছে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ। এমন পরিস্থিতিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিতেও লজ্জা পাচ্ছেন অনেকেই। ছাত্রলীগ নিয়ে কথা বলতেও রাজি হননি সাবেক দুই নেতা সুলতান মনসুর ও বাহাদুর বেপারী।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ছাত্রলীগ। তিনি বলেন, ৭৫-পরবর্তী সময়ে সেনা শাসকরা দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে মেধাবী ছাত্রদের বৈষয়িক ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রমোদ বিহারে নিয়েছিল মেধাবী ছাত্রনেতাদের। তাদের হাতে অস্ত্রও তুলে দিয়েছিল। এর মাধ্যমেই পচন ধরা শুরু হয় ছাত্রনেতাদের। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল দেশ রূপান্তরকে বলেন, নব্বই-পরবর্তী সময়ে পথ হারাতে থাকে ছাত্রসংগঠনগুলো।
ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতা বলেন, এত প্রলোভন সত্ত্বেও ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির আলোই জে¦লেছিল ছাত্রলীগ। নানা অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে রাজনীতি করতে হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের হাতে নিহত হয় ছাত্রলীগের আটজন। ‘এইট মার্ডার’ হিসেবে পরিচিত ওই ঘটনা আজও মনে পড়ে সবার। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই পথ হারাতে শুরু করে ছাত্রলীগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, ১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন আনন্দ নামে এক ছাত্রনেতা। এর এক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিকের বিরুদ্ধে ওঠে ধর্ষণের অভিযোগ, যিনি ধর্ষণের জন্য ‘সেঞ্চুরি মানিক’ হিসেবে পরিচিত। এভাবেই অর্জনগুলো বিসর্জন হতে হতে আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি এই তিন মূলনীতির ছাত্রলীগ। বলা যায়, নানা সোনালি অর্জনের দাবিদার ছাত্রলীগে নব্বই-পরবর্তী সময়ে ঘুণ ধরেছে। এখন তিন মূলনীতির ধারেকাছেও নেই দেশের প্রাচীনতম এই ছাত্রসংগঠন।
ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিকট অতীতে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপারে সংগঠনটির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। গত কয়েক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রদের দাবি আদায়ের কোনো অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করতে দেখাই যায়নি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। বরং বেতন বৃদ্ধি, আবাসন সমস্যার সমাধান ও চাকরিতে সুবিধাপ্রাপ্তিসহ যেসব ইস্যুতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে, সেখানেই ছাত্রলীগ নিয়েছে বিপরীত অবস্থান।
এসব আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ তো দূরের কথা, আন্দোলনগুলো ব্যর্থ করার জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। কখনো কখনো তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল থেরে বেরও করে দিয়েছেন তারা। শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ের পাশাপাশি শান্তি ও প্রগতির ব্যাপারেও কোনো পদক্ষেপ এই সংগঠনটির নেতারা নিয়েছেন কি না তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে অশান্তি, অশিক্ষা ও প্রগতিবিরোধী ভূরি ভূরি কর্মকা- রয়েছে ছাত্রলীগের নামে। এসব নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারকে দফায় দফায় বেকায়দায় ফেলেছে এই ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীদের হাতে প্রাণ গেছে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর, ছাত্রলীগের মারামারির কারণে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। টেন্ডারবাজি, দখল, তদবিরবাজি এমনকি মাদকসেবী এবং মাদক কারবারিও রয়েছে এই সংগঠনে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুয়েটে নির্যাতনের মুখে আবরার ফাহাদের হত্যাকারীরাও ছিল মাদকাসক্ত। সব মিলে এসব কারণে যেন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ছাত্রলীগের গঠনতান্ত্রিক নেতার দায়িত্বভারও ছেড়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেন আরেক অংশের নেতারা। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন।
২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। ২০১২ সালে ছাত্রলীগ নেতার চাপাতির কোপে প্রাণ হারান পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস।
সব মিলে ২০০৯ থেকে ’১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ যায় ৪১ জনের। ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ গেছে অন্তত ১৫ জন সাধারণ মানুষের। সর্বশেষ বুয়েটের ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এই ছাত্রলীগের নেতারা। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিয়ে ছাত্রলীগ আজকে পরিবার, সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
’৯০ সালের স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অসীম কুমার উকিল। তিনি বলেন, নব্বইয়ের পরের ছাত্রলীগ পথ হারিয়েছে। তখন পর্যন্ত ছাত্রলীগ ইতিবাচক রাজনীতি করেছে। এরপরের ছাত্রলীগে নেতিবাচক রাজনীতির চর্চা শুরু হয়। অসীম কুমার উকিল মনে করেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটও এর জন্য দায়ী। তিনি আরও বলেন, এখনকার ছাত্রলীগ নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। অবশ্য ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব তৈরি করার কারখানা দাবি করে তিনি বলেন, এই সংগঠন অবশ্যই থাকতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দেবে।
সাবেক ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা বলেন, ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের ভেতরেরই একটি অংশ রয়েছে নানা অপরাধ-অপকর্মে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করার প্রতিযোগিতায় নামে। ছাত্রলীগকে দিয়ে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি করানো হয়; এমনকি মাদক কারবারও করানো হয় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে।
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা ছাত্রলীগের সম্মেলনের সময়ে ‘নিজ বলয়ের’ ছেলেদের নেতা বানানোর প্রতিযোগিতায়ও নামেন। এ প্রতিযোগিতায় লাখো-কোটি টাকা বিনিয়োগও করেন তারা। এ প্রতিযোগিতায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতারাও রয়েছেন। নেতা বানানো হলে ওই নেতারা নানা অপরাধ-অপকর্মে ব্যবহার করেন তাদের।
ছাত্রলীগের আরেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক খ ম জাহাঙ্গীর বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এ ঘটনার পর আমি এই সংগঠন করি এটা বলতেও লজ্জা পাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ছাত্র রাজনীতির অধঃপতনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যখনই বৈষয়িক ব্যাপারগুলো এসেছে ছাত্রনেতাদের ভেতরে তখনই নষ্ট হয়েছে ছাত্রলীগ-ছাত্র রাজনীতি। খ ম জাহাঙ্গীর বলেন, আমাদের সময়ে আমরা ক্যাম্পাসভিত্তিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক ও জাতীয় ইস্যুতে জনমত তৈরি করার জন্য কাজ করতাম। আদর্শ থেকে, বিশ্বাস থেকে রাজনীতি করতাম। এখনকার ছাত্রলীগ ক্লাব স্টাইলের ছাত্রলীগ হয়ে গেছে। আমরা কখনো ইঞ্জিনিয়ারের অফিস চিনতাম না। টেন্ডার কী জিনিস বুঝতাম না। আমাদের সময়ে প্রতিযোগিতা হতো কার কত বেশি কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তা নিয়ে। এখন তো ছাত্রসংগঠন মানে আতঙ্ক।