ঢাকা শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


ইডেন ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ নেই,ভয়াবহ সিট বাণিজ্যের অভিযোগ,জিম্মি সাধারণ ছাত্রীরা


১ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:২৬

আপডেট:
১ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:৩৪

 ইডেন ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ নেই,ভয়াবহ সিট বাণিজ্যের অভিযোগ,জিম্মি সাধারণ ছাত্রীরা

এক দশক ধরে তাঁরা আছেন ইডেন কলেজে। কারোরই ছাত্রত্ব নেই। কমিটির মেয়াদও নেই। তবু তাঁরা ছাত্রলীগের নেত্রী। ভর্তি-বাণিজ্য, সিট দখলসহ নানা অভিযোগ ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের এই নেত্রীদের বিরুদ্ধে। শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরা নয়, তাঁদের নির্যাতনের কারণে নিজ সংগঠনের নেত্রীরাও অতিষ্ঠ।
২০১৬ সালে নভেম্বরে সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন তাসলিমাকে আহব্বায়ক করে ১৬ জন যুগ্ন আহব্বায়ক ৬১জন সদস্য দিয়ে তিন মাসের ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি করেন। তিন মাসের কমিটি দুই বছর শেষ হলেও হয়নি নতুন কমিটি।


ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ই জানুয়ারী আগে তাঁরা সেভাবে কলেজের রাজনীতিতে ছিলেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তারা।পরবর্তী সভাপতি জেসমিন আক্তার নিপা এবং সাধারণ সম্পাদক ইশরাত জাহান অর্চির কমিটি ভেঙ্গে তিন মাসের জন্য আহব্বায়ক করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আর এই অবৈধ কমিটি বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। দুই বছর ধরে তাঁরা ভর্তি-বাণিজ্য ও হলে সিট-বাণিজ্য করছেন। অভিযোগ আছে এ কাজে তাঁরা কলেজ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পান। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, টাকার বিনিময়ে হলে বহিরাগতদের কাছে সিট ভাড়া দেন ছাত্রলীগ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার প্রাচীন আর বড় এই কলেজের ছাত্রীনিবাসগুলোতে মূলত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আসন-বাণিজ্যের শিকার হয়ে আসছেন। এর বাইরে শিক্ষাজীবন শেষে অনেক শিক্ষার্থীও টাকার বিনিময়ে হলে থাকার সুযোগ নেন। তাঁদের কেউ কেউ মাসিক ভাড়াও দিয়ে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের কয়েকজন এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন।

কলেজটিতে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে ছয়টি আবাসিক হলে আসনসংখ্যা ৩ হাজার ৩২০। কর্তৃপক্ষ বলছে, হলে কমবেশি ৭ হাজার শিক্ষার্থী থাকছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজিয়া হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের চারটি তলার মোট ৭৪টি কক্ষ কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এসব কক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ‘রাজনৈতিক কক্ষ’ নামে পরিচিত। রাজিয়া হলে ২২টি কক্ষে কমবেশি ৩৩০ জন ছাত্রী থাকেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের ৫২টি কক্ষে কমবেশি ৪০০ শিক্ষার্থী। নেত্রীরা বাদে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই টাকার বিনিময়ে এসব কক্ষে আসন নিয়েছেন। আনুমানিক হিসাবে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীপ্রতি ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ধরলে বছরে এসব কক্ষ থেকে কমপক্ষে ৮০ লাখ টাকার বাণিজ্য চলে।

 

গত কয়েক মাসে কলেজের বিভিন্ন বিভাগের কমপক্ষে ৮০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীর তুলনায় হলে আসন কম থাকার সুযোগ নেন নেত্রীরা। আবার শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও অনেকে অর্থের বিনিময়ে এসব রাজনৈতিক কক্ষে থাকার সুযোগ পান। এমনকি কিছু কিছু আসনে বহিরাগত ছাত্রীদের থাকার অভিযোগ রয়েছে। নেত্রীদের মাধ্যমে হলে ওঠায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে (মিটিং, মিছিল, সমাবেশ) যাওয়া বাধ্যতামূলক। এতে তাঁদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। কিন্তু হলে থাকতে হলে এসব মেনে নিতে হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজিয়া হল রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সক্রিয়। ছাত্রলীগের নেত্রীদের বেশির ভাগই এই হলে থাকেন। পাঁচতলা এই হলের নিচতলা ও দোতলার ২২টি কক্ষের সব কটি ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে। প্রতিটি কক্ষে চারটি বিছানায় আটজনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এসব রাজনৈতিক কক্ষে কমপক্ষে ১৫ জন করে ছাত্রী থাকেন। কোনো কোনো কক্ষে আরও বেশি ছাত্রী থাকছেন। তবে পালাক্রমে বিছানা-মেঝেতে থাকার রুটিন এক দিন পরপর পরিবর্তন হয়।

 

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে ৫২টি রাজনৈতিক কক্ষ। এতে ছাত্রীর সংখ্যা কমবেশি ৪০০। গ্যাসের চুলা ও লিফটের সুবিধা থাকায় নতুন এই হলে ছাত্রীদের ওঠাতে ১৫-২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। চাহিদা বেশি হলে কারও কারও কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকাও নেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক এবং বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, আসন-বাণিজ্যের পাশাপাশি নেত্রীদের ভয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকেন হলের সাধারণ ছাত্রীরা। ছোটখাটো অজুহাতে গালাগাল, এমনকি মারধরেরও শিকার হতে হয়। হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ জন্য ছাত্রীরা কোনো অনিয়মের প্রতিবাদ করেন না। হল প্রশাসনও চুপ।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী ১৫ হাজার টাকা দিয়ে রাজিয়া হলে উঠেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী হলে উঠেছেন ১৩ হাজার টাকা দিয়ে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা হলের এক ছাত্রী বলেন, গ্যাসের চুলার সুবিধা থাকায় হলে উঠতে তাঁকে ২৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষাজীবন শেষ হওয়া ছাত্রীরা মাসিক ২ হাজার টাকায় সিট ভাড়া দিয়ে হলে থাকেন বলে জানা গেছে।

কলেজের বাকি চারটি হলেও এমন বাণিজ্য হচ্ছে। তবে এসব হলে রাজনৈতিক প্রভাব কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলেজে ছাত্রলীগের দ্বিতীয় সারির নেত্রীরা আসন-বাণিজ্যে সরাসরি যুক্ত থাকেন। তবে এই অর্থ সংগঠনের প্রথম সারির নেত্রীদের কাছে জমা দিতে হয়। কলেজের শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাছলিমা আক্তার, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহনাজ আক্তার, মাহবুবা নাসরীন, নাসিমা আক্তার ও পাপিয়া প্রিয়ার বিরুদ্ধে আসন-বাণিজ্য নিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

রাজিয়া হলের প্রভোস্ট কামরুন নাহারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। এসব বিষয়ে তিনি অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রভোস্ট শামসুন নাহার বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য আমার জানা নেই।’

 

ইডেন কলেজে আবাসিক হলের আসন নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। আগের সরকারের সময় ছাত্রদলের নেত্রীদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। তবে এখন বাণিজ্যের পরিধি বেড়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।