ঢাকা সোমবার, ২৫শে আগস্ট ২০২৫, ১০ই ভাদ্র ১৪৩২


গাজায় ত্রাণপ্রার্থীদের 'অমানবিকভাবে হত্যার' ঘটনায় ইসরায়েলের প্রতি ২৮ দেশের নিন্দা


প্রকাশিত:
২২ জুলাই ২০২৫ ১৩:১১

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি

অবিলম্বে গাজা যুদ্ধের অবসান চেয়েছে যুক্তরাজ্যসহ মোট ২৮টি দেশ। তারা বলছে সেখানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ 'নতুন করে ভয়াবহ এক পর্যায়ে পৌঁছেছে'। যৌথ এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের ত্রাণ সরবরাহ পদ্ধতিকে 'বিপজ্জনক' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে "অসামঞ্জস্যপূর্ণ ত্রাণ বিতরণ এবং খাদ্য ও পানি চাইতে আসা বেসামরিক নাগরিকদের অমানবিকভাবে হত্যার" নিন্দা জানানো হয়েছে।

গাজায় হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় গত সপ্তাহের শেষে খাবারের অপেক্ষায় থাকা একশ'রও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আরও ১৯ জন মারা গেছেন অপুষ্টিজনিত কারণে।

তবে দেশগুলোর এই বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, "এই বিবৃতি বাস্তবতা বিবর্জিত এবং হামাসকে ভুল বার্তা দেয়।"

মিথ্যা প্রচারণা চালানো এবং ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত করার অভিযোগে হামাসকে অভিযুক্ত করেছে ইসরায়েলের এই মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, হামাস নতুন কোনো যুদ্ধবিরতি বা জিম্মি বিনিময় চুক্তিতে রাজি হচ্ছে না।

গত ২১ মাসে হামাসের সাথে যুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলের কৌশল নিয়ে নিন্দা জানিয়ে অনেক আন্তর্জাতিক বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ঘোষণাটি অকপটে স্বীকার করার জন্য উল্লেখযোগ্য।

এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যুক্তরাজ্য এবং আরও ২৭টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, নিউজিল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ড।

বিবৃতিটির শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছে যে "গাজায় এখনই যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত।" বিবৃতিতে দেশগুলো সতর্ক করে বলেছে, "গাজায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ নতুন স্তরে পৌঁছেছে। ইসরায়েল সরকারের ত্রাণ সরবরাহ মডেল বা পদ্ধতি বিপজ্জনক ও অস্থিরতা তৈরি করছে এবং গাজার মানুষদের মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করছে।"

"আমরা ধীরগতির ত্রাণ বিতরণ এবং খাদ্য ও পানি পাওয়ার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে শিশসহ বেসামরিক মানুষকে অমানবিক হত্যার নিন্দা জানাই। এটা ভয়াবহ যে ত্রাণ চাইতে গিয়ে আটশ'র ও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।"

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি হাউস অব কমন্সে পরে বলেন, গাজায় এক "ভয়াবহতার তালিকা" হচ্ছে, এর মধ্যে এমন হামলাও রয়েছে যাতে "অনাহারে থাকা শিশুদেরও" হত্যা করা হচ্ছে।

গাজার জন্য অতিরিক্ত ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড মানবিক সহায়তা ঘোষণা করে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি জানান তিনি "ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের অধিকারের এক অবিচল সমর্থক"।

তবে ইসরায়েল সরকারের বর্তমান কর্মকাণ্ড "বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েলের মর্যাদাকে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি করছে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিরাপত্তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।"

গত মে মাস থেকে ইসরায়েল যখন ১১ সপ্তাহব্যাপী অবরোধ কিছুটা শিথিল করে তখন থেকেই প্রায় প্রতিদিনই খাবারের জন্য অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের হত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সহায়তায় গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশন নামে একটি নতুন সহায়তা ব্যবস্থা চালু করা হয়। যা কিনা জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত পুরোনো ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে চলে।

ইসরায়েলের দাবি, গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশন হামাসের হাত থেকে ত্রাণ চুরি রোধ করে। কিন্তু জাতিসংঘ এবং এর সহযোগী সংস্থাগুলো এই ব্যবস্থায় কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা বলছে, এই ব্যবস্থা নিরাপদ নয় এবং মানবিক সহায়তার নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা ও স্বাধীনতার নীতিকে লঙ্ঘন করে।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশন চালু হওয়ার পর গত আট সপ্তাহে সেখানে অন্তত ৬৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে।

এছাড়া জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার ত্রাণের রুটে আরও ২০১ জন নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার খান ইউনিস এবং রাফার কাছে দুইটি গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশনে আরও ৩৯ জন নিহত হন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সাইট খোলার আগে সন্দেহভাজনদের উদ্দেশে সতর্কতামূলক গুলি চালিয়েছে তারা।

রোববার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর গাজায় এক ক্রসিং পয়েন্টের কাছে জাতিসংঘের ত্রাণবাহী ট্রাক লক্ষ্য করে এগিয়ে আসা নাগরিকদের ওপর গুলিতে ৬৭ জন নিহত হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী "তাৎক্ষণিক হুমকি মোকাবিলায়" সতর্কতামূলক গুলি চালানোর দাবি করলেও নিহতদের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছে।

এ ঘটনার পর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সতর্ক করে বলেছে, গাজায় ক্ষুধার সংকট "হতাশার নতুন স্তরে পৌঁছেছে"।

জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বলেছে, "মানবিক সহায়তার অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অপুষ্টির ভয়াবহতা বাড়ার সাথে সাথে ৯০ হাজার নারী ও শিশুর জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েছে।"

হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত শনিবার থেকে অপুষ্টির শিকার মানুষদের মধ্যে ১৯ জন মারা যাওয়ার তথ্য দিয়েছে সোমবার। একইসাথে ভবিষ্যতে 'বহু মৃত্যুর' আশঙ্কা জানিয়েছে।

দেইর আল বালাহ' র আল – আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র চিকিৎসক খলিল আল দাকরান বিবিসিকে বলেন, "হাসপাতালগুলো এখন আর রোগী বা কর্মীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না। এদের মধ্যে অনেকেই চরম ক্ষুধার কারণে শারীরিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েছে।"

তিনি আরও বলেন, "ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া শিশুদের জন্য হাসপাতালগুলো এক বোতল দুধও দিতে পারছে না। কারণ বাজারে এখন আর কোনো বেবি ফর্মূলা নেই।"

খাদ্য স্বল্পতার কারণে বাজারগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্বানীয় বাসিন্দারা।

দুই সন্তানের বাবা মোহাম্মদ ইমাদ আল দিন, যিনি পেশায় নাপিত, বিবিসিকে বলেন, "আমার বাচ্চারা সারারাত ক্ষুধায় কাঁদে। গত তিনদিনে তারা কেবল একটুখানি ডাল খেয়েছে। কোনো রুটি নেই। এক সপ্তাহ এক কেজি আটার দাম ছিল ৮০ ডলার (৫৯ পাউন্ড)।"

বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দেওয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, গাজার ২১ লাখ মানুষকে দক্ষিণ রাফায় স্থানান্তরে 'মানবিক শহর' এর ইসরায়েলি প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।

এই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, "স্থায়ীভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।"

"তাৎক্ষণিকভাবে, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এই ভয়াবহ সংঘাতের অবসান ঘটাতে" ইসরায়েল, হামাস এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।

তারা এটিও সতর্ক করেছে যে, "তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য একটি রাজনৈতিক পথ তৈরির পক্ষে আরও পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত।"

এটিকে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবেও অনেকে মনে করছেন যা অনেক দেশ ইতোমধ্যেই করেছে। কিন্তু যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এখনো করেনি।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন অবশ্য এই সমালোচনাকে অস্বীকার করেছেন। "হামাস এই যুদ্ধ শুরু করে চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার বদলে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে ব্যস্ত। একই সময়ে তারা মানবিক সহায়তা নিতে আসা মানুষের ক্ষতির মত পরিস্থিতি তৈরি করছে" বলেন তিনি।

চলতি মাসের শুরুতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, অপেক্ষমান সাহায্যপ্রার্থী বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতির কিছু ঘটনা ঘটেছে। একই সাথে তারা "জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত কমাতে কাজ করছে।"

ত্রাণ সমন্বয়কারী ইসরায়েলি সামরিক সংস্থা কোগাট সোমবার বলেছে, "ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাজ করছে এবং গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে।"

গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে তাদের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসাথে জাতিসংঘ গাজায় সহায়তা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে বলে জাতিসংঘকে অভিযুক্ত করেছে এই ফাউন্ডেশনটি। বর্ডার পার হওয়ার সময় সাহায্য সামগ্রী পঁচে যাচ্ছে বলে চ্যাপলিন ফে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। কারণ জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সেগুলো বিতরণ করছে না।

রোববার ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ত্রাণবাহী ৭০০ ট্রাক জাতিসংঘ নেবে বলে সীমান্তে অপেক্ষমাণ রয়েছে। চলমান সংঘাত, মানবিক সহায়তার গতিবিধির ওপর ইসরায়েলি বিধিনিষেধ এবং জ্বালানি ঘাটতির কারণে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর হামাসের সীমান্ত হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে গাজায় অভিযান শুরু করে। হামাসের হামলায় প্রায় বারশো জন নিহত হয় এবং জিম্মি করা হয় ২৫১ জনকে। গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে অন্তত ৫৯ হাজার ২৯ জন মানুষ নিহত হয়েছে।