ঢাকা রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


অপেক্ষায় কোটি শিক্ষার্থী


৪ জানুয়ারী ২০২১ ২০:২৮

আপডেট:
৪ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৩০

করোনার কারণে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ এক বছর

  • ইন্টারনেটে নিষিদ্ধ অ্যাপসে ঢুঁ
  •  অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন
  • স্কুলে যেতে চায় শিক্ষার্থীরা
  • শিক্ষার্থীদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ছে
  • শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে
  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখায় একটা অনীহা চলে এসেছে


করোনায় বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজ করছে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ। কবে শেষ হবে এ মহামারি। কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কবে দেখা হবে সহপাঠীদের সঙ্গে। এরূপ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কোনো কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ এখনো চূড়ান্তই করতে পারেনি সরকার।

দফায় দফায় বাড়ানো হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়। অনলাইনে বা টেলিভিশনে বিকল্প শিক্ষাদানের চেষ্টা হলেও তাতে সাফল্য এসেছে খুব কমই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় কোনো ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি এ সময়ে। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করা হয়।

আর উচ্চশিক্ষায় তো সেশনজটের কবলেই রয়েই গেলো। প্রায় বছর খানেক হতে চলল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এতে করে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতায় এক ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সারাদিন-রাত বাসায় থেকে শিক্ষার্থীদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট গেমসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। স্মার্টফোনের প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থী ব্ল– ফিল্ম, টিকটক, লাইকিসহ নানা নিষিদ্ধ অ্যাপসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

এতে নষ্ট হচ্ছে নৈতিকতা, কমে যাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। এদিকে, সন্তানদের নিয়ে মহাটেনশনে দিনাতিপাত করছে অভিভাবকরাও। গত এক বছরে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী মারামারি, খুন, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায় রয়েছে কোটি কোটি শিক্ষার্থী। উল্লেখ্য, করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, ‘সরকার যখনই স্কুলগুলো খোলার বিষয়ে চিন্তা শুরু করল, তখনই করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এল। কাজেই আমাদের ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করেই স্কুল না খুলে এখন ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এর মধ্যে যদি অবস্থা ভালো হয়, তাহলে স্কুল খোলা হবে, না হলে আমরা খুলব না।’ এ ছাড়া করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্য বই পড়ার এবং শরীরচর্চা ও খেলাধুলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চা চালিয়ে নেওয়ার জন্যও অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক স্তর, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম  বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখায় একটা অনীহা চলে এসেছে। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্লাস ও পরীক্ষা না থাকায় তারা তাদের সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে পারছে না। ফলে তাদের মধ্যে একঘেয়েমি একটা ভাব চলে এসেছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত খেলার মাঠও নেই যেখানে তারা সময় কাটাবে।

ফলে করোনায় শিক্ষার্থীদের বাইরে বেরোনের ফুসরত নেই। এমতাবস্থায় তারা মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের এ ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প নেই বলে মনে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের এই অধ্যাপক।
সংক্রমণ এড়াতে চলতি বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে এই ছুটি। আগামী বছরও যথাসময়ে এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না বলে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষাও নেয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে দেয়া হয়নি অটোপাসও। ফলে এসব শিক্ষার্থীর পিছিয়ে গেল এক বছর।
ইতোমধ্যে বিগো লাইভ, টিকটক ও লাইকি নামের অ্যাপ ব্যবহারে তরুণ প্রজম্ম বিপথগামী হওয়ায় এসব অ্যাপ বন্ধ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয় সচিব এবং বিটিআরসি’র চেয়ারম্যানকে এ নোটিশ পাঠানো হয়।

গত ৮ই অক্টোবর রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিশটি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে আর খাঁন রবিন। নোটিশের বিষয়ে আইনজীবী জে আর খাঁন বলেন, এসব অ্যাপের ব্যবহার তরুণ প্রজম্মকে বিপথগামী করছে। তরুণ ও কিশোররা গ্যাংয়ে জড়িয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে, হয়ে উঠছে সহিংস। এই অ্যাপসের মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায় এবং নিজেকে জনপ্রিয় ভাবতে শুরু করে।

বিগো-লাইভ অ্যাপের মাধ্যমে তরুণ ও যুবকদের টার্গেট করে লাইভে এসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দিয়ে এবং যৌনতার ফাঁদে ফেলে কৌশলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই অ্যাপের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে ভারত ও পাকিস্তান এই অ্যাপটি নিষিদ্ধ করেছে।টিকটকের মাধ্যমে অনেক কিশোর-তরুণ উদ্ভট রঙে চুল রাঙিয়ে এবং ভিনদেশি অপসংস্কৃতি অনুসরণ করে ভিডিও তৈরি করছে, যাতে সহিংস ও কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট থাকে। উদ্বেগজনক যে এ টিকটক ভিডিওগুলোতে নেই কোনও শিক্ষণীয় বার্তা। উল্টো এসব ভিডিওর মাধ্যমে তরুণ প্রজম্মর কাছে ভুল বার্তা চলে যাচ্ছে। বিব্রতকর, অনৈতিক ও পর্নোগ্রাফিকে উৎসাহিত করায় ইতোমধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় এগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
দি আইডিয়াল একাডেমির শিক্ষার্থী ফারদিন শাহরিয়ার অর্ক বলেন, আমার মন ভালো না, অনেক দিন স্কুলে যেতে পারি না, বন্ধুদের সাথে দেখা হয় না, ভালো লাগে না, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ রাখা হচ্ছে। আমরা স্কুলে যেতে চাই।
ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী ও জেরিন হাছান কান্তা বলেন, আমরা চাই ক্যাম্পাসে যেতে, ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিতে। বোরিং লাইফ আর ভালো লাগে না। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি জানান তিনি।
ফরিদপুর জেলার একটি সরকারি স্কুলের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাকওয়া ইসলামের মা বলেন প্রায় এক বছর ধরে স্কুলে যেতে পারছে না তার মেয়ে। ফলে এই শিক্ষাবর্ষের অনেক কিছুর সাথে পরিচিত না হয়েই তাকে পরবর্তী ক্লাসে উঠতে হচ্ছে। স্কুলের যে একটা সার্বিক পরিবেশ। অনেকগুলো বাচ্চার সঙ্গে মেশা ও শেখা। এখন বাসায় পড়ানোর চেষ্টা করলেও দেখা যায় তার আগ্রহ নেই। পরীক্ষা হচ্ছে না অনেক দিন ধরে। পরীক্ষা কিভাবে হয় সেটাই আসলে তার মনে নেই। পড়ার যে আগ্রহ সেটা অনেকটাই কমে গেছে। এমনকি তার আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। আমরা অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, সবকিছুই চলছে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে শিক্ষার্থীরা অনেক যোজন যোজন পিছিয়ে পড়বে। যা ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।