বিপুল উদ্দীপনায় সফলভাবে সম্পন্ন হলো ‘বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০২৫’
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হলো তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম বৃহৎ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুমাত্রিক আয়োজন ‘বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০২৫। গত ২১ ও ২২ জুন, ২০২৫, রাজধানীর সেনাপ্রাঙ্গণে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কন্ট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো)-এর আয়োজনে এবং ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিজনেস প্রোমোশন কাউন্সিল-এর সহযোগিতায় ষষ্ঠবারের মতো এবারের সামিট অনুষ্ঠিত হয়।
“BPO 2.0: Revolution to Innovation” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের সামিটে বিপিও খাতের রূপান্তরের পাশাপাশি উদ্ভাবনের গতিপথকে তুলে ধরা হয়। দুই দিনব্যাপী এই আয়োজনে দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক, তরুণ পেশাজীবী এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সরব উপস্থিতি সামিটকে একটি বিশ্বমানের প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে।
সামিটে ৩০টিরও অধিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইটিইএস/বিপিও প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা ও পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পায়। বিপিও খাতের সামগ্রিক অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজন করা হয় নয়টি থিমভিত্তিক সেমিনার ও কর্মশালা, যেখানে ৮৬ জন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞগণ, কর্পোরেট নেতৃবৃন্দ ও সরকারের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিগণ বক্তা হিসেবে অংশ নেন। সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন ও আইটি পলিসি সংক্রান্ত নানা বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় উঠে আসে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা।
এবারের সামিটে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ছিল একাধিক Expo Zone এবং Experience Zone যেখানে দর্শনার্থীরা সরাসরি অভিজ্ঞতা নিতে পেরেছেন প্রযুক্তির ভবিষ্যতের সঙ্গে। উল্লেখযোগ্য এক্সপেরিয়েন্স জোনগুলোতে ছিল স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা, জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত AR (Augmented Reality) ও VR (Virtual Reality) অভিজ্ঞতা, উন্নতমানের ড্রোন ও সাবমেরিন টেকনোলজি, এবং রোবট প্রদর্শনী—যা আগত অতিথি ও তরুণ দর্শনার্থীদের জন্য প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
তরুণদের জন্য ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও চাকরি মেলা ছিল সামিটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। বিপিও খাতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয় বিশেষ কর্মশালা, যেখানে তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয় আউটসোর্সিং শিল্পের সম্ভাবনা ও পেশাগত বিকাশের বাস্তব চিত্র। চাকরি মেলার মাধ্যমে শতাধিক তরুণ তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেয় যেখান থেকে ১০০ এর অধিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
ফ্রিল্যান্সারদের সমস্যা, সফলতা ও ভবিষ্যৎ পথনকশা নিয়েও আয়োজন করা হয় পৃথক সেমিনার, যেখানে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই খাতকে আরও সুসংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সামিটে ফ্রিল্যান্সার ফোরামের ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা তুলে ধরেন বক্তারা।
নীতিমালা সংশোধন ও খাতভিত্তিক নীতিনির্ধারণ নিয়েও হয় বিশেষ পলিসি সংলাপ, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিগণ, আইসিটি খাতের নীতিনির্ধারক, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও গবেষকরা। এ সেশনে আউটসোর্সিং শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
সামিটে কর্মক্ষেত্রে নারী বিষয়ক সেমিনারে নারীর নেতৃত্ব, নিরাপদ পরিবেশ এবং সমান সুযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বক্তারা নারীর দক্ষতাকে বিপিও খাতের বিকাশে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন। এই উদ্যোগ নারীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সম্ভাবনাময় কর্মপরিসরের বার্তা দেয়।
সামিটে আরো আয়োজন করা হয় ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) ও আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের ভূমিকা, এবং বৈশ্বিক অংশীদারত্ব ও আউটসোর্সিংয়ের ভবিষ্যৎ বিষয়ক গুরুত্ববাহী সেমিনারসমূহ যাতে অংশ নেন দেশি-বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ, যারা আউটসোর্সিং খাতে অর্থপ্রবাহ সহজীকরণ, বৈশ্বিক বিনিয়োগ, অংশীদারিত্ব সম্প্রসারণ এবং টেকসই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনে করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাহবুবুর রহমান, সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ড. মুঃ নজরুল ইসলাম, সচিব (পূর্ব), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আবু সাঈদ, মহাপরিচালক, আইসিটি অধিদপ্তর, বাক্কো সভাপতি তানভীর ইব্রাহীম, এবং ফয়সল আলিম, সাধারণ সম্পাদক, বাক্কো।
উল্লেখ্য, উক্ত অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, এনডিসি। নিম্নে তাঁদের বক্তব্যের একাংশ তুলে ধরা হলোঃ
সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক আলোচনায় বক্তব্য রাখেন বাক্কো সভাপতি তানভীর ইব্রাহীম। বাক্কো এবং বিপিও শিল্পের অর্জন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আলোকপাত করে তিনি বলেন, “বাক্কো বর্তমানে ৪৩০-এর অধিক সদস্য নিয়ে দেশের বিপিও শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ পর্যন্ত আমরা ৮৫,০০০-এর বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি এবং বার্ষিক ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রাজস্ব অর্জন করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ লক্ষ টেকসই কর্মসংস্থান ও ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় নিশ্চিত করা, যা অর্জনে বাক্কো তার বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। এই সামিট আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর অন্যতম মাইলফলক”।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “বিপিও খাত দেশের রপ্তানি আয়ের একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই খাতের বিকাশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বদা নীতিগত সহায়তা প্রদান করবে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) ড. মুঃ নজরুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের বিপিও খাতকে বিশ্বে তুলে ধরতে কূটনৈতিক মহলের আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এই সামিট সেই আন্তর্জাতিক সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।”
দুইদিন ব্যাপি এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন আবু সাঈদ, মহাপরিচালক, আইসিটি অধিদপ্তর। তিনি বলেন, “চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিপিও শিল্প প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থানে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আইসিটি অধিদপ্তর এই যাত্রায় পাশে থাকবে।”
অনুষ্ঠানের সভাপতি আইসিটি অধিদপ্তরের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, এনডিসি বিপিও শিল্পে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে বলেন, “বিপিও শিল্পের অগ্রযাত্রা আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠছে। এই খাতের বিকাশে সরকার ও শিল্পখাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা আরও জোরদার হবে। তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তি জগতে যুক্ত করতে হলে তাঁদের হাতে সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ পৌঁছে দিতে হবে। বিপিও সামিট সে সুযোগটিই তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে আমাদের আগামী প্রজন্ম প্রযুক্তিনির্ভর রপ্তানি আয় তৈরির সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে।
অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্য রাখেন বাক্কোর সাধারণ সম্পাদক ফয়সল আলিম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে তিনি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, “এই সামিটে অংশগ্রহণকারী সবাই আমাদের একটি শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে তোলার পথ দেখিয়েছে। তরুণদের জন্য বিপিও এখন শুধু একটি চাকরি নয়, বরং একটি ক্যারিয়ার।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বৈশ্বিক আউটসোর্সিং ইকোসিস্টেমে অন্যতম শক্তি। তাঁদের সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরতে আমরা সামিটে বিশেষ সেশন করেছি। ভবিষ্যতে বাক্কো ফ্রিল্যান্সারদের উন্নয়নে সরকার ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।”
সামিটে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণ, যারা বাংলাদেশের বিপিও শিল্পের অগ্রযাত্রা ও বৈশ্বিক সক্ষমতা নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন। উপস্থিত ছিলেন প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিক, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী।
উল্লেখ্য, এবারের সামিটে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে ছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (BIJF) ও টেকনোলজি মিডিয়া গিল্ড বাংলাদেশ (TMGB)।
বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০২৫-এর সফল বাস্তবায়নে দেশের খ্যাতনামা বিপিও, আইটিইএস, ব্যাংকিং ও প্রযুক্তি খাতের অগ্রণী প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উল্লেখযোগ্য সহযোগিতার নিদর্শনস্বরূপ, ডায়মন্ড স্পন্সরশিপ ক্যাটাগরিতে যুক্ত হয়েছে রকি ডায়লার এবং স্কাই টেক গ্লোবাল লিমিটেড; প্লাটিনাম স্পন্সরশিপে অংশ নিয়েছে সিনার্জি আইটি সার্ভিসেস লিমিটেড ও ব্রোটেক্স টেকনোলোজিস লিমিটেড। গোল্ড স্পন্সর হিসেবে ছিল সিনার্জি বিজনেস সল্যুশন। সেমিনার স্পন্সর হিসেবে অবদান রেখেছে ২৪/৭ ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টস, আকিজ টেলিকম লিমিটেড, এএসকে টেলিকম লিমিটেড, আয়েশা সার্ভিসেস (এএসএল বিপিও), ইগনাইট টেক সল্যুশনস, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি এবং ইউনিকার্ট। এছাড়াও, টেকনোলোজি পার্টনার হিসেবে ছিল এডিএন টেলিকম লিমিটেড ও টেকনো; লাইফস্টাইল পার্টনার হিসেবে অ্যাডোনিস গ্রুপ; এবং নলেজ পার্টনার হিসেবে সিসি-এপিএসি, কোচ কাঞ্চন একাডেমি ও সিওপিওসি এই আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
‘বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০২৫’ শুধু একটি সম্মেলন নয়, বরং এটি ছিল বাংলাদেশকে বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি ও আউটসোর্সিং বাজারে একটি প্রতিশ্রুতিশীল শক্তি হিসেবে তুলে ধরার দৃঢ় ও সুপরিকল্পিত প্রয়াস।