ঢাকা মঙ্গলবার, ৬ই মে ২০২৫, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩২


দুই মাসুদের অপকর্মে ডুবতে বসেছে ইসলামী ব্যাংকগুলো


৬ মে ২০২৫ ১৭:৫১

আপডেট:
৬ মে ২০২৫ ২০:৫৭

বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোঃ সাইফুল আলম মাসুদ প্রায় ডজনখানেক ব্যাংকের মাধ্যমে ২ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন। প্রায় এক যুগ ব্যাংকিং খাত বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকিং লুট করার পরে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এসেও বিতর্কিত এস আলমের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেই যাচ্ছেন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান উবাইদুল্লাহ আল মাসুদ। তার এই কাজে সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছেন এস আলমেরই অন্যতম সহযোগী নাবিল গ্রুপের কর্ণধার আমিনুল ইসলাম স্বপন। ব্যাংক লুটের টাকা দিয়েই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজশাহী মহানগরীর আর্থিক যোগান দিয়ে আসছেন নাবিল গ্রুপের এই স্বপন। যার ফলে তিনি জামায়াতে ইসলামী থেকেও কৌশলে আনুকূল্য নিচ্ছেন।

নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে থাকা এস আলম সংশ্লিষ্টদের অর্থ উত্তোলন, ব্যাংকগুলোর শেয়ার সুরক্ষা ও এস আলমের স্বার্থ রক্ষাসহ তার ফিরে আসার পথ খোলা রাখতে মরিয়া হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মিডিয়া অঙ্গনে কোটি কোটি টাকার ক্যাশ লেনদেনের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক ও নাবিল গ্রুপের এক বিশাল সিন্ডিকেট। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দেশের সর্বোচ্চ সম্পদ পাচারকারী মাফিয়া এস আলম এখনও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার প্রভাব বজায় রেখেছে।

এস আলমের পাচার অর্থ ফেরৎ আনা ও এই মাফিয়া গোষ্ঠীর গিলে ফেলা সম্পদ পূণরুদ্ধারে ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের সক্রিয় কর্মকর্তা, বোর্ড মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের হয়রানি করতে ক্যাশ লেনদেনের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে একটি গ্রুপ। দুদকের মাধ্যমে হয়রানির জন্য ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ২০১৭ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ঘটনাগুলো আড়াল করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একের পর এক চিঠি দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে লুটেরা বিরোধী সৎ ও দক্ষ ব্যাংকারদের। তাদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বানোয়াট নিউজ করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ক্যাশ টাকা অফার করে সাংবাদিকদের মিথ্যা নিউজ করতে উৎসাহিত করা হয় নাবিল গ্রুপের লোকজনের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে মিথা তথ্য দিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক রাজশাহী জোনের প্রধানকে।

এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সংস্কার ও অন্যান্য কাজেও বাধা প্রদান করছেন একটি চক্র। যাতে ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ও নাবিল গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এস আলমের লুটপাটের চিত্র জনসম্মুখে আনার কারণেই এই মাফিয়ারা উঠে পড়ে লেগেছে। দুদকের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের আলোচিত সংবাদ “ভয়ংকর নভেম্বর” এর মতো শীর্ষ পাচার ও লুটের মতো বিষয় এড়িয়ে যেতেই এস আলমের স্বাভাবিক ব্যবসা করার সময়ের নথিপত্র গুলো সামনে আনা হচ্ছে। অথচ দুর্নীতির মহাযজ্ঞ চলে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। স্বাভাবিক চিত্রগুলো সামনে আনার পাশাপাশি এস আলম বিরোধী ব্যাংকারদের হয়রানি অব্যাহত রাখতে পারলে এই মাফিয়ার ফিরে আসার পথ সুগম হবে বলেই চক্রটি এসব করছে বলে দুদক সূত্রে জানা যায়। আর এ জন্য ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ও এস আলমের সহযোগী স্বপন কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক ও মিডিয়ার পেছনে ব্যয় করছে।

মিডিয়া হাউজে এস আলমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা লোকদের লিস্ট করে তাদের বিরুদ্ধে নিউজ করানোর চেষ্টা চলছে। এদিকে, এস আলমের ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারগুলো নাবিল গ্রুপের মাধ্যমে ক্রয় করার প্রচেষ্টা চালায় জামায়াতের কয়েকজন নেতা। উল্লেখ্য নাবিল গ্রুপের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। এসব তথ্যাদি ফাঁস হওয়া এবং পরবর্তীতে দুদকের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এস আলম কর্তৃক নাবিল গ্রুপের শেয়ার ক্রয়ের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এর পেছনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।

এছাড়া বিএনপির সালাহউদ্দিন বিগত এক দশক যাবৎ এস আলমকে সাপোর্ট দিয়ে আসছে। ৫ আগস্টের পর এস আলমের ঢাকা ও চট্টগ্রামে থাকা দামী গাড়িগুলো তার মাধ্যমে হস্তান্তরে চেষ্টা চলে। এমনকি সালাহউদ্দিনকে এস আলমের গাড়ি ব্যবহার করছে এমন অবস্থায় হাতেনাতে ধরা হয়। গণমাধ্যমে সংবাদটি ভাইরাল হলে সালাহউদ্দিনকে বিএনপির পদ স্থগিত করার মতো উদ্যোগও নেয়া হয়। সালাহউদ্দিন বিতর্কিত হলে এস আলমের ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিএনপির মাধ্যমে হস্তান্তরের দায়িত্ব আসে বিএনপির আরেক নেতা গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের উপর। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারগুলো বিএনপি বাগিয়ে নিতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়।

ইসলামী ব্যাংক দখল করতে যুবদল নেতা নয়নের নেতৃত্বে অস্ত্রধারী কিছু সন্ত্রাসী ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ৬ জনকে গুলিবিদ্ধ করে। নানাবিধ চাপ, বৈষমী বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাদের সক্রিয় বাধার মুখে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন খুব একটা এগুতে পারেনি। এস আলমের শেয়ার হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়ে ১৪০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয় বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। কিন্তু এতে বাধ সাধে নতুন এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যন খুরশিদ ওয়াহাব। মূলত এই বিনিয়োগ পাশ করিয়ে শেয়ার কেনার চেষ্টা চালায় বিএনপি। যাতে এস আলমের সরাসরি যোগসাজস পাওয়া যায়।

এ উদ্যোগ ব্যর্থ হলে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ইসলামী ব্যাংকে এস আলম ও বিএনপির অবস্থান পাকাপোক্ত করার দায়িত্ব পায়। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান শেয়ার কেনার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ক্রয়ের জন্য তাকে নিযুক্ত করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক ও ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের নানাবিধ পদক্ষেপে এই সকল আয়োজন ও কূটকৌশল ব্যর্থ হয়।

এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকেই ইসলামী ব্যাংকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ওবায়েদুল্লাহ আল মাসুদ ব্যাংকটির লক্ষ কোটি টাকা পাচারকারী তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে সাথে নিয়ে এস আলমের ছকে ব্যাংকটি পরিচালনা করে আসছিলেন। ৫ আগস্টের পরও এস আলমকে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক বাণিজ্য সুবিধা দেয় মাসুদ ও মওলা। পরিবার পরিজনসহ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেয়া এই এস আলম ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়। গত ১৫ মার্চ এস আলম এই কমিটমেন্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে টাকা ফিরিয়ে না দিয়ে যারা এস আলমের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদেরকে হয়রানির জন্য নতুন ছক আঁকে। এই ছক অনুযায়ী দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলম সহযোগীদের মাধ্যমে ২০১৭ সাল পরবর্তী ঋণ গুলোর বিনিয়োগে অনুসন্ধান বাদ দিয়ে এর আগের নথিপত্র ব্যবহার করে সংস্কারপন্থীদের হয়রানির জন্য নানাবিধ চিঠি ইস্যু করতে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সহ একসময় তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্যান্য ব্যাংকগুলোতে যারা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামে এস আলমের মাফিয়াচক্র। গত এপ্রিল মাসে প্রায় ডজনখানেক মিডিয়া হাউজে এস আলমে বিরুদ্ধে কাজ করছে এমন ব্যাংকার ও অডিটরদের বিরুদ্ধে বানোয়াট নিউজ করতে ক্যাশ নিয়ে হাজির হয় ইসলামী ব্যাংক ও নাবিল গ্রুপ সংশ্লিষ্ট কিছু লোক। যারা মূলত এস আলমের সুবিধাভোগী ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ও আমিনুল ইসলাম স্বপনের লোক। একাধিক সাংবাদিকদের অর্থ নিয়ে নিউজ করতে নানাবিধ প্রচেষ্টা চালায় এই চক্র। এছাড়া এস আলমের কুকীর্তির নিউজ প্রকাশ না করতে জামায়াতে ইসলামীর রেফারেন্সে অনুরোধ করা হয়। কয়েকজন সার্থান্বেষী ও টাকায় বিক্রি হয়ে এস আলমের বিরুদ্ধে যাতে নিউজ না হয় এ জন্য কাজ করছে। পাশাপাশি সংস্কারকারীদের বিরুদ্ধে হয়রানির নানান ফন্দি আটছে।

ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ ছুটিতে থাকা এমডি মুনিরুল মওলাকে দিয়ে মাত্র দুটি এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) ব্যবহার করে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের নামে বাংলাদেশ থেকে পাচার করে প্রায় ৮১৫.৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনা অংশীদার সেপকোর (ঝঊচঈঙ) যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত এ প্রকল্পে ‘মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির’ নামে এই বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়, প্রকৃতপক্ষে একটি যন্ত্রপাতিও দেশে আসেনি।

রুপালী ব্যাংকের মাধ্যমে খোলা দুইটি এলসির বিপরীতে ১৮৪টি ইনভয়েস জমা দেওয়া হলেও অধিকাংশই ছিল ভুয়া বা ভবিষ্যতের তারিখে ইস্যুকৃত। এমনকি কিছু ইনভয়েসে ব্যবহৃত হয়েছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নাম ও রপ্তানিকারক কাগজপত্র। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে এসএস পাওয়ারের কোনও আমদানি তথ্য নেই, অথচ বৈদেশিক মুদ্রা ঠিকই ছাড় হয়েছে। এই ঘটনার সময় রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মোঃ উবাইদুল্লাহ আল মাসুদ, যিনি বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের চেয়ারম্যান।

ইসলামী ব্যাংকে যোগদানের আগে ইসলামী ব্যাংকের একটি আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে তার নাম এসেছে। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের ফার্মগেট শাখা থেকে বিতর্কিতভাবে ৯৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ গ্রহণকারী 'মার্ক বিজনেস লিমিটেড' নামের প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন তার ছেলে জুনায়েদ জুলকার নাইন এবং উপদেষ্টা ছিলেন তিনি নিজে। অভিযোগ রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এস আলম গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের বিশাল অর্থায়ন এস আলম গোষ্ঠীর হাতে যায়।

এসএস পাওয়ার প্লান্ট ও মার্ক বিজনেস লিমিটেড –সংক্রান্ত বিতর্কিত আর্থিক লেনদেনের পটভূমিতে উবায়দুল্লাহ আল মাসুদের ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ এবং তার ভূমিকা নিয়ে এস আলম গ্রুপের প্রভাব ও স্বার্থরক্ষার প্রশ্ন সামনে এসেছে। বিশেষ করে রূপালী ব্যাংকে তার দায়িত্বকালে এসএস পাওয়ারের বিতর্কিত অর্থ ছাড় এবং পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংকে তার দায়িত্ব গ্রহণ এই ধারাবাহিকতা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত বলেই মনে করছেন ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা।
তার বিরুদ্ধে উঠেছে ব্যাংকিং খাতে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে পদ লাভ, এবং বিতর্কিত বিনিয়োগ ও অর্থপাচারের অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক ও আর্থিক সম্পর্কই এই লেনদেনকে সহজতর করেছে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ বিতরণের ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়। ওই সময় ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণে ছিল এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্টদের নামে তখন একাধিক সন্দেহজনক লেনদেন, বড় অঙ্কের ‘শেল কোম্পানি’ ঋণ এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে। এগুলোর মধ্যে কিছু অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত শুরু করলেও কোনো দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডে পরিবর্তন আসে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি। এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধিদের বোর্ড থেকে সরিয়ে ব্যাংকটিকে একটি অপেক্ষাকৃত ‘নিরপেক্ষ’ ব্যবস্থাপনায় ফেরানোর উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, এই প্রস্থান সাময়িক এবং গ্রুপটি শিগগিরই নতুন রূপে ফিরে আসবে।

আগে থেকেই ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান এস আলমের হয়েই কাজ করতেন। রূপালী ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকালে উবায়দুল্লাহ আল মাসুদ এসএস পাওয়ার ও মার্ক বিজনেস লিমিটেড সংক্রান্ত বিতর্কিত লেনদেনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এসএস পাওয়ারের নামে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার অর্থ ছাড়ে সহায়তা করেন, যা পরবর্তীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস এবং ব্যাংক খাতের তারল্য সংকটে বড় ভূমিকা রাখে।

রাজনীতির দুই মেরুতে দক্ষ ভারসাম্য
সংশ্লিষ্টরা বলছেন চেয়ারম্যান মোঃ উবাইদুল্লাহ আল মাসুদ একজন ব্যাংকার হলেও তার পদোন্নতি ও পদের পেছনে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ছিল অন্যতম নিয়ামক। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনামলে কর্মসংস্থান ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং সর্বশেষ রূপালী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি বিএনপি সংশ্লিষ্ট কিছু মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। ইসলামী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক ভারসাম্যের এই কৌশল তাকে চেয়ারম্যানের পদে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে। শুধু তাই নয়, তার ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ এস আলম গ্রুপের সরাসরি প্রভাব এবং আগ্রহের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতের পর্যবেক্ষকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “যার ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে বিতর্ক রয়েছে, যিনি পূর্বে এস আলমের স্বার্থরক্ষা করেছেন, তাকেই ফের ইসলামী ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো এটা কাকতালীয় হতে পারে না।”

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা সংকট
বিশ্লেষকরা বলছেন, একই ব্যক্তি দুই ব্যাংকে উচ্চপদে থেকে দুটি বড় অর্থপাচার সংশ্লিষ্ট ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ত থাকায় রাষ্ট্রীয় ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যখন ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ আপত্তি জানিয়েও বিপুল বিনিয়োগ অনুমোদন পায়, তখন এ প্রশ্ন আরও প্রবল হয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ করছে কে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের বৃহৎ অর্থ ছাড়, এলসির ডেটা যাচাই না করে বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়, রপ্তানিমুখী ইনভয়েসে আমদানি দেখিয়ে লেনদেন সবই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা বা সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়।

দুর্বল গ্রাহককে বিশাল ঋণ সুবিধার আয়োজন
সম্প্রতি ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মওলা ও বর্তমান চেয়ারম্যান যৌথভাবে সালমা গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১,১২৪ কোটি টাকার বিনিয়োগের অনুমোদন দিতে উদ্যোগী হন। ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ এই বিনিয়োগে আপত্তি জানালেও তা পাশ করানোর জন্য জোর তৎপরতা চালানো হয়। তবে পরবর্তীতে বিনিয়োগটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ
বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, তিনি ব্যাংকের প্রশাসন, পদায়ন ও বদলি সংক্রান্ত কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত নির্দেশনা না মেনে একক সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছেন। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে উদ্দেশ্য করে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নৈতিক ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রশ্ন
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকরা বলছেন, এক ব্যক্তির পেছনে রাজনৈতিক, কর্পোরেট ও পারিবারিক স্বার্থের এতগুলো সুতো জড়িত থাকলে, ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলামী ব্যাংক দেশের বৃহৎ ইসলামী শরিয়াভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর কার্যক্রম ও পরিচালনা আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।

তদন্ত দাবি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ
এই পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কাছে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার স্বার্থে স্বাধীন তদন্তের দাবি উঠেছে। ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে এ ধরনের অভিযোগের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সময়োপযোগী তদন্ত অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক খাত তদারকি বিভাগ (FSSD), ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ (DBI) এবং বিএফআইইউ (BFIU) এর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে তারা কেন এত বড় অঙ্কের বিতর্কিত লেনদেন, পেমেন্ট ও চুক্তিসমূহ পর্যাপ্তভাবে পরীক্ষা না করে ছাড় দিয়েছেন।