ঢাকা সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩২


ডিসেম্বর প্রান্তিকে ২০ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ১.১৮ লাখ কোটি টাকা


৫ মে ২০২৫ ১১:১৯

আপডেট:
৫ মে ২০২৫ ১৭:৫৮

ব্যাংকখাতের ব্যাপক পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাপক পরিমাণে বাড়ায়, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ২০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এ চিত্র।

সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এই ঘাটতি ৫৩ হাজার ২৫৩ কোটি টাকার হলেও— ডিসেম্বর প্রান্তিকে সার্বিক ঘাটতি বেড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এসময়ে আরও ৪টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়ে বলে জানাচ্ছে ব্যাসেল-৩ এর অধীনে মূলধন সংরক্ষণ বাফার সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে, ১০টি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ৩৯ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির সম্মুখীন হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতের সম্মিলিত মূলধন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের অনুপাত বা সিআরএআর কমে দাঁড়িয়েছে ৩.০৮ শতাংশে, যা সেপ্টেম্বরের শেষে ছিল ৬.৮৬ শতাংশ।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম একটি মাত্রায় মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৫০০ কোটি টাকা– এরমধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো ব্যাংক এই শর্ত মানতে ব্যর্থ হলে, সেটি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে বলে গণ্য হবে।

মূলধনের এই অর্থ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ এবং ব্যাংকের মুনাফা থেকে সংরক্ষিত হয়। যেসব ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি থাকে, তারা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে না। এছাড়া, বিদেশি ব্যাংকগুলো প্রায়শই স্থানীয় ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি যাচাই করে তারপর ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করে।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, যার মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।

মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বৃদ্ধির কারণে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। ফলে অনেক ব্যাংক তাদের মুনাফা থেকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, যা তাদের মূলধন ঘাটতিকে আরও তীব্র করেছে।

তিনি বলেন, "বর্তমানে যেসব ব্যাংকের নতুন করে মূলধন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে এই লোকসান বহন করছিল। তবে আগের সরকার দ্বারা তারা সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এসব তথ্য গোপন ছিল। এখন সেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে।"

নুরুল আমিন বলেন, মূলধন ঘাটতির ফলে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা হ্রাস পায়, যা তার আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে। এসব ব্যাংক প্রভিশন বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে লভ্যাংশ দিতে পারবে না এবং ধীরে ধীরে গ্রাহকও হারাবে।

তিনি আরও বলেন, মূলধন ঘাটতির কারণে এসব ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে, ক্রেডিট রেটিংয়ে পতন হবে। বিদেশি ব্যাংকগুলোও তাদের সঙ্গে লেনদেনে সতর্কতা অবলম্বন করবে। এতে কিছুক্ষেত্রে এলসি খোলার সময় মার্জিনও বেড়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক, কোর্টল্যান্ডের অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেন, মূলধন ঘাটতির পেছনে দায়ী ব্যাংকগুলোর দুর্বল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত।

তিনি বলেন, বর্তমান মূলধন ঘাটতি এসব ব্যাংকের দুর্বল অবস্থাকেই তুলে ধরছে, নতুন পুঁজি না পেলে– তাদের টিকে থাকাই কঠিন। তার ভাষায়, "এসব ব্যাংকের অধিকাংশই আইসিইউতে রয়েছে।"

ড. পাল বলেন, মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা দিতে পারবে না, তাদের ঋণের মান খারাপ হবে, নতুন বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে না এবং পুরো খাত ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে যাবে।

২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ (এনপিএল) বেড়ে হয়েছে ১.৩৪ লাখ কোটি টাকা, যার ফলে ডিসেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের মধ্যে খেলাপিই এখন ২০.২ শতাংশ।

এছাড়া, ডিসেম্বর শেষে মন্দ ঋণের বিপরীতে ১৩টি ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকায়। এসব ঘাটতি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে পুরো খাতটিতেই নতুন করে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ডিসেম্বর শেষে যে মূলধন ঘাটতি দেখা গেছে, মার্চ ২০২৫-এর প্রতিবেদনে তা আরও বাড়তে পারে। কারণ মার্চ থেকে প্রভিশনিং হার আরও কঠোর করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আগে স্পেশাল মেনশন একাউন্ট (এসএমএ) শ্রেণিভুক্ত ঋণের জন্য প্রভিশনিং হার ১ শতাংশ থাকলেও, মার্চ থেকে তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

এই অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাংকগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার ও নতুন মূলধন সংযোজন করতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় যদি ব্যাংক প্রভিশন স্থগিত সুবিধা দেয়, তাহলেও কিছুটা ঘাটতি কমে আসতে পারে।

ওই সেই কর্মকর্তা জানান, কিছু ব্যাংককে শর্তসাপেক্ষে এই সুবিধা দেওয়া হতে পারে। কিছু ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর যারা ব্যর্থ হবে, তারা হয়তো একীভূত (মার্জার) হতে বাধ্য হবে।

এদিকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বাড়লেও, পুরো খাতের অবস্থা এতে প্রতিফলিত হয় না। বরং কিছু ব্যাংক ১,০০০ কোটিরও বেশি মুনাফা করেছে এবং শক্তিশালী আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।